আজ ১৯ ফেব্রুয়ারি,ঠিক ১২৬ বছর আগে বিশ্ব বিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় পদার্পণ করেছিলেন!

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭ আজ থেকে ঠিক ১২৬ বছর আগে এমনই এক ১৯ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় পদার্পণ করেছিলেন।১৫ ই ফেব্রুয়ারি মাদ্রাজ থেকে জাহাজে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ১৮ তারিখ এসে পৌছলেন বন্দরে। সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ায় তৎকালীন নিয়ম অনুসারে জাহাজেই রাত্রি বাস করে ১৯ তারিখ ভোরে বজ বজ থেকে ট্রেনে করে শিয়ালদা স্টেশনে উপস্থিত হলেন।
তাকে স্বাগত জানাতে তৈরি হয় অভ্যর্থনা কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে দুটি তরণ তৈরি করা হয় একটি শিয়ালদায় হ‍্যারিসন রোডের সংযোগস্থলে আরেকটি রিপন কলেজের সম্মুখে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রিপন কলেজ পর্যন্ত পতাকা,ফুল, লতা পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছিল।
সেদিন ভোরে শিয়ালদা স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার যুবকের সঙ্গে কুমুদ বন্ধু সেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, " যখন স্বামীজীর সেই স্পেশাল ট্রেন এল তখন মাননীয় আনন্দ চার্লু ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে পড়েই গেলেন, স্বেচ্ছাসেবকরা কোনরকমে তাকে বাইরে নিয়ে গেল। তখন চারুচন্দ্র মিত্র মহাশয় আমাদের আদেশ দিলেন," তোমরা স্বামীজীকে বেস্টন করে আমরা যে রাস্তা দেখাচ্ছি সেই রাস্তা দিয়ে আমাদের অনুসরণ করে নিয়ে যাবে"। আমরা তদনুসারে স্বামীজীর ঘিরে-ঘিরে চললাম। কামরা থেকে যখন স্বামীজি নামেন, তখন প্রণাম করতে বললেন," That's all right."
স্বামীজি পৌঁছানো মাত্রই চারিদিকে স্বামীজীর জয়ধ্বনি উঠতে লাগল। চারুবাবুর নির্দেশ দিলেন কোচম্যানকে ঘোড়া খুলে দিতে এবং আমাদের গাড়ি টেনে নিয়ে যেতে বললেন। স্বামীজি তাতে আপত্তি করলেন, কিন্তু চারু বাবু বললেন," আমরা আপনাকে সংবর্ধনা করছি, আপনার আপত্তি টিকবে না। এরা রিপন কলেজ পর্যন্ত অনায়াসে আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে"।
তখন স্বামীজি ফুলমালা সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে জোড়হাত করে সকলকে প্রণাম করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন সেভিয়ার মিসেস সেভিয়ার গুডউইন সাহেব সিডনে উপবিষ্ট। লিটনের পিছনে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে ঠাকুর স্বামীজীর জয়ধ্বনী করছেন। যখন আমহাস্ট স্ট্রিটের মোড়ের কাছে বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর বাসভবনের সম্মুখে লোকের ভিড়ে ফিটন দাঁড়িয়েছিল তখন আমরা দেখি ত্রিতলের বারান্দা থেকে গোঁসাইজী স্বামীজীকে জোড়হস্তে প্রণাম করছেন। স্বামীজী ও তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রণাম করলেন।
অতি কষ্টে স্বামীজীকে কোনরকমে পুরাতন রিপন কলেজের সংকীর্ণ প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হল। সামান্য একটি ক্ষুদ্র বারান্দায় টেবিল চেয়ার দিয়ে স্বামীজীকে বসানো হলো। সেখানে বক্তৃতা করা অসম্ভব। স্বামীজীর শুধু দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন," তোমাদের উৎসাহে এবং সংবর্ধনায় আমি মুগ্ধ হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি।

ভোরের লোকাল ট্রেন সাড়ে সাতটায় শিয়ালদহে থেমেছে, স্টেশন তত ক্ষণে মুখরিত ‘জয় পরমহংস রামকৃষ্ণ কি জয়,’ ‘জয় স্বামী বিবেকানন্দ কি জয়’ আওয়াজে। কসমোপলিটান রাজধানী সে দিন হিন্দি ভাষাতেই জয়ধ্বনি তুলেছিল। ভিড় ঠেলে অভ্যর্থনা কমিটির সেক্রেটারি, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন কোনও ক্রমে এগিয়ে গেলেন, বিবেকানন্দকে বসিয়ে দিলেন স্টেশনের বাইরে অপেক্ষারত ল্যান্ডো গাড়িতে।

বিবেকানন্দ সেভিয়ার দম্পতিকে নিয়ে সেই গাড়িতে বসতেই এক দল ছাত্র এগিয়ে এসে ঘোড়া দুটোকে লাগাম থেকে খুলে নিজেরাই গাড়ি টানতে শুরু করল। সামনে ব্যান্ড পার্টি, মাঝে গাড়ি আর পিছনে খোল-করতাল সহ কীর্তনের দল। সেলেব্রিটি বরণের এই রকম ইভেন্ট আগে কখনও দেখেনি কলকাতা।

রাস্তার দু’ধারে ফুল নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ। সার্কুলার রোডে ‘জয় স্বামীজি’ লেখা তোরণ, ওপরে নহবতখানা। হ্যারিসন রোডের মোড়ে আর একটা, রিপন (সুরেন্দ্রনাথ) কলেজের গেটে লেখা ‘স্বাগত’।

কলকাতা এ দিন একটা ব্যবস্থা করেছিল। রাস্তায় কোনও সভা নয়, শুধু শোভাযাত্রা। ঠিক হয়েছিল, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সভা হবে ৯ দিন পরে, ২৮ ফেব্রুয়ারি। শোভাবাজার রাজবাড়িতে। বিস্ত়ৃত প্রাঙ্গণ, অনেকেই সন্ন্যাসীর বক্তৃতা শুনতে পারবে।

বিবেকানন্দের গাড়ি দুপুরবেলায় পৌঁছল বাগবাজারে পশুপতিনাথ বসুর বাড়িতে। এ দিন এখানেই তাঁদের দুপুরের খাওয়ার বন্দোবস্ত। অতঃপর বরাহনগরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়ি। বিদেশি শিষ্যদের সেখানে রেখে তিনি চললেন আলমবাজার।

সাত বছর আগে, যে দিন বিবেকানন্দ বেরিয়েছিলেন, মঠ ছিল বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে। পরে ১৮৯২ সালে তরুণ সন্ন্যাসীরা চলে আসেন আলমবাজারের এই বাড়িতে। বিবেকানন্দ তখন খেতড়িতে। খবরটা পান চিঠিতে। এই ১৯ ফেব্রুয়ারি আলমবাজার মঠে তাঁর প্রথম পদার্পণ।

প্রবেশদ্বারে কলাগাছ, আম্রপল্লবসহ জলভরা কলসি সাজিয়ে রেখেছেন সতীর্থ অখণ্ডানন্দ ও রামকৃষ্ণানন্দ। অন্যরা কলকাতা গেলেও এই দুই গুরুভাই সারা দিন থেকে গিয়েছেন মঠে, তৈরি হয়েছে ছোটখাটো এক তোরণও।

কলকাতায় ফিরে বিবেকানন্দ দিনের বেলায় বিদেশি শিষ্যদের কাছে, গোপাল লাল শীলের বাগানবাড়িতে থাকেন। রাতে আলমবাজার। কখনও শাস্ত্রচর্চা, কখনও বা জানলায় হ্যামক টাঙিয়ে বই পড়েন। মাঝে মাঝে গুনগুন করেন গীতগোবিন্দের গান।

ফেরার তিন-চার দিন পর বাগবাজারে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ। সেখানেই চাঁদা নিতে হাজির গোরক্ষিণী সভার এক প্রচারক। ঘটনাটা আজও বিখ্যাত। বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মধ্যভারতে দুর্ভিক্ষে প্রায় আট লাখ লোক মারা গিয়েছে। আপনারা তাঁদের জন্য কিছু করছেন না?’ ভদ্রলোকের উত্তর, ‘না, ওটা ওঁদের কর্মফল।’ বিবেকানন্দের সটান জবাব, ‘তা হলে গরুরাও নিজেদের কর্মফলে কসাইখানায় যাচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই।’ নাছোড়বান্দা ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু শাস্ত্র বলে, গরু আমাদের মা।’ বিবেকানন্দের উত্তর, ‘দেখেই বুঝেছি। তা না হলে এমন কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?’

২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় শোভাবাজার রাজবাড়ির সভা। দালান উপচে পড়ছে মানুষের ভিড়ে। সেখানেই বললেন, ‘আজ সন্ন্যাসী ভাবে আসিনি, ধর্মপ্রচারক হিসেবেও নয়। এসেছি সেই কলকাতাবাসী বালক রূপে।…’

একটার পর একটা বক্তৃতা। শোভাবাজার, স্টার থিয়েটার। ৭ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি, এত বছর বাদে এলেন দক্ষিণেশ্বর। তবু তাঁকে দেখতে ভিড়ে ভিড়াক্কার। শরীর দিচ্ছে না, কিন্তু মাথায় অনেক পরিকল্পনা। তৈরি করতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মঠ ও মিশন। জন্মতিথির পর দিনই শরীর সারাতে দার্জিলিঙের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। সাত বছর পর কলকাতায় এসে বিবেকানন্দ থাকলেন মাত্র ১৬ দিন। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ।

শরীরের কথা কবে আর খেয়াল রাখলেন তিনি? শোভাবাজারে সভার তিন দিন আগেও মার্কিন শিষ্যা ওলি বুলকে লিখছেন, ‘এত ক্লান্ত, জানি না আর ছ’মাসও নিজেকে টানতে পারব কি না। তবে, কলকাতা আর মাদ্রাজে দুটো সেবাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। মাদ্রাজের লোকেরা বেশ আন্তরিক। কলকাতার বড়লোকেরা স্রেফ দেশপ্রেমের কারণে এ বিষয়ে উৎসাহী, উৎসাহ কাজে পরিণত হবে বলে মনে হয় না।’ বিবেকানন্দ জানতেন, শুধু দেশপ্রেমের বুকনিতে চিঁড়ে ভেজে না।

এই কথাগুলি মনে রাখাতেই ১২৬ বছর আগের সেই দিনটার সার্থকতা। আজও বজবজের ‘গুডস ক্যারেজ ইউনিট’-এ পুরনো রেল স্টেশনের অতিথিশালা সাজানো হবে ফুল আর মালায়, বজবজ-শিয়ালদহ লোকালের একটা কামরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে সেখানে রাখা হবে ফাইবার গ্লাসে তৈরি বিবেকানন্দের মূর্তি।