অশান্ত বাংলাদেশ,বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে সহিংসতায় ৬ জনের মৃত্যু, অগ্নিগর্ভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পতনের ভয়ে উদ্বিগ্ন শাসকদল

ঢাকা, জাকির হোসেন: বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশি সহিংসতায় ১৬ জুলাই মঙ্গলবার দেশজুড়ে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পথচারী রয়েছেন৷ ১৭ জুলাই বুধবার বিকেলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সদস্যরা৷ দুপুর থেকে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷ বরাবরের মতো পুলিশ, ছাত্রলীগ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর। এদের সাথে যোগ দেয় বিজিবি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ অস্ত্র ও কৌশল বিভাগ (সোয়াট)৷ মুহুর্মুহু গুলি এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তারা৷ এই সংবাদ লেখা অবধি মারাত্মকভাবে আহত হয় প্রায় তিনশ' শিক্ষার্থী, গুলিবিদ্ধ হয় ৩৫ জন৷ এদের মধ্যে ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও বিজিবি৷ ভেতরে শিক্ষার্থীরা কী অবস্থায় আছে, তার কিছুই জানা যাচ্ছে না৷ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় নেটওয়ার্ক একদম বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে শাসকদলের হুকুমে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রাতের আঁধারে গোপন কিলিং মিশন চালাতে পারে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও এদের সাথে ছাত্রলীগও রয়েছে বলে সূত্র মারফত খবর৷ ইতিমধ্যে অনেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার খবর আসতে শুরু করেছে৷ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে৷ এতে ২৫ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর জানা গেছে যাদের মধ্যে ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর একাধারে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ৷ কাঁদানে গ্যাস, রাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে তারা৷ পুলিশকে সহায়তা করে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা৷ সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় ৪৫ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়৷ এছাড়া বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট সহ দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে৷ থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে দেশজুড়ে৷ এদিকে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ওপর ক্রমাগত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে ভারতের বামপন্থী ছাত্রসংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এআইএসএ)৷ হামলায় উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ বাংলাদেশের চলমান ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিও মিলার৷ উদ্বেগ জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। সহিংস হামলা থেকে বিক্ষোভকারীদের রক্ষা করতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি। স্থানীয় সময় ১৬ জুলাই মঙ্গলবার রাষ্ট্রসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এসব কথা বলেন।

রামদা, লাঠিসোটা ও বিভিন্ন দেশীয় অয়াত্র নিয়ে ঢাকার সায়েন্সল্যাবে তাণ্ডব চালায় শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা৷ ১৭ জুলাইয়ের চিত্র৷

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের এক দফা দাবিতে’ ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। এ কর্মসূচি চলাকালে শুধু হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা৷ জরুরি সেবার আওতায় গণমাধ্যমের গাড়ি ও সংবাদপত্র পরিবহনের গাড়ি বাধাহীনভাবে চলতে পারবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ জানালেন, "শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা ও কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে ১৮ জুলাই সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করছি৷ শুধু হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলবে না, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া সড়কে কোনো গাড়ি চলবে না৷"

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সংগ্রহের সময় ছাত্রলীগের হামলায় আহত টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ৷

গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সকালে ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করতে শুরু করে। ফলে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ অনেক শহরের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে যায় এবং মহাসড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও সড়কে অবস্থান নেয়ায় কয়েকটি স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ অনেক স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে। রংপুরে লাঠিচার্জ ও গুলি করে পুলিশ৷ এসব সহিংসতায় ঢাকায় দুইজন, রংপুরে একজন, চট্টগ্রামে তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে৷ গত ১৫ জুলাই সোমবার সারা দেশে রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর শাসকদল আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হামলা, কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং কোটা প্রথার যৌক্তিক সমাধানের দাবিতে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার নতুন করে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তখন ছাত্রলীগের হামলায় ঢাকায় দুইশ' শিক্ষার্থী আহত হয়। এর আগে, ১৪ জুলাই রবিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় বাসভবন 'গণভবনে' এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার করা এক মন্তব্যের পর ওই রাতেই নতুন করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর পরের দিন ১৫ জুলাই সোমবার ঢাকাসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা ঘটে৷ এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে মাঠে নেমে এসেছে এবার স্কুল কলেজের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও৷ সাথে তাদের বাবা-মায়েরাও আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে রাস্তায় নেমে আসে৷ রাজধানী ঢাকা সহ পুরো দেশজুড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে, তাতেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ৷ পুরো দেশে প্রায় সাড়ে চারশ' স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর জানা গেছে৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা: আন্দোলন বেগবান হওয়ায় কার্যত বাধ্য হয়েই শাসকদল ১৭ জুলাই বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে৷ সব শিক্ষার্থীকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে অবিলম্বে হল ছাড়তে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। সেইসাথে, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা এসেছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার মাঝে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ও অনির্দষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে হল ছাড়তে বলা হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদেরকে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মাঝে, কিন্তু ছাত্রদেরকে ১৭ জুলাই বুধবার বিকাল তিনটার মাঝে হল ত্যাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল৷ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত দিয়েছে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ এদিকে, সিটি করপোরেশন এলাকাভুক্ত সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রক৷ চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে৷ ১৭ জুলাই বুধবার বরিশালে ছাত্রলীগের হামলায় ১২ জন আন্দোলনকারী আহত হয়৷ ময়মনসিংহে প্রতীকী কফিন নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে আন্দোলনকারীরা৷ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ জন, ফেনীতে ২০ জন আহত হয়৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা শান্তিপূর্ণভাবে পড়ার সময় পুলিশ একজন ইমামকে আটক করে৷ এছাড়াও পুরো দেশে আন্দোলনকারীদের ধরপাকড় করেছে পুলিশ৷ ছাত্রলীগের হামলায় প্রতিনিয়ত আহতের খবর আসছে৷ ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছাত্রলীগ ও পুলিশের সম্মিলিত গুলিবর্ষণকালে শহীদ হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রাফি৷ তার স্মরণে সাইন্সল্যাবের নাম পরিবর্তন করে 'শহীদ রাফি চত্ত্বর' করার ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা পোষণকারী ঢাকার নাগরিকরা৷ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ অসীম সাহসিকতায় পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে মৃত্যুকে বরণ করে নেন৷ রংপুরের পার্কের মোড়ের নাম পরিবর্তন করে 'শহীদ আবু সাঈদ চত্বর' করার ঘোষণা দেয় সেখানকার স্থানীয় জনতা৷

0:00
/0:35

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলির সামনে অসীম সাহসিকতায় নিজের বুক পেতে দেন৷ এসময় তার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে শহীদ হন আবু সাঈদ৷ শহীদ আবু সাঈদকে পুলিশের এই গুলি করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশজুড়ে বিক্ষোভের ঢেউ শুরু হয় শাসকদলের পতন ঘটানোর স্লোগানে৷

১৪ জুলাই রবিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন তোলেন, ''মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের বাচ্চা-নাতিপুতিরা পাবে?'' হাসিনার ওই বক্তব্যের জের ধরে ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য হচ্ছে, "কোটা সংস্কারের দাবিতে পুরো দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করছে৷ আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে৷ আমরা কোটাব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলছি৷ আমরা বলছি না যে কার মেধা আছে আর কার মেধা নেই৷ আমরা বলছি কোটা সংস্কার হোক, বিস্তৃতভাবে মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের নিয়োগ হোক৷ কোটা রাখলে তা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসুক৷ ১০০ ভাগের ৫৬ ভাগই যদি কোটায় নিয়ে যায় তবে সাধারণদের জন্য বাকি আর কী থাকে! ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী এরকম একটা মন্তব্য করেছেন যে আমাদের দেশভক্তি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলছেন! অথচ আমরা আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে লালন করে চলেছি এবং আমরা রাজাকার পরিবারেরও সন্তান নই৷ কোটা সংস্কার বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াই৷ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লড়াই না৷" কোটা সংস্কার এর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল সমাবেশে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেসময় কয়েকটি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা৷ মধ্যরাতে মিছিলকারীরা আবাসিক হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ‘তুমি কে আমি কে - রাজাকার, রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং ‘কোটা নয় মেধা- মেধা মেধা’- এ ধরনের স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাজাকার বলায় তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে তারা ওই স্লোগান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর করা মন্তব্যকে 'অপমানসূচক' বলে বর্ণনা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা৷ ১৪ জুলাই রবিবার রাত থেকেই হাসিনার করা মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে খোদ তার দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগেরই কয়েকজন হল পর্যায়ের নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন৷ এরপরেই দেশজুড়ে পদত্যাগের হিড়িক ওঠে৷ এখন অবধি দেশজুড়ে ছাত্রলীগের প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন৷ ২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে সরকার। সম্প্রতি সেই পরিপত্র বাতিল করে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চলতি মাসের শুরু থেকে টানা আন্দোলন ও 'বাংলা ব্লকেড' নাম দিয়ে অবরোধের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ১৪ জুলাই রবিবার দিনের বেলায় আন্দোলনকারীরা ঢাকার বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দেয়। এতে সংসদের অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেয় আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা এ সময়ের মধ্যে তুলে নেওয়ার দাবি জানায়।

0:00
/0:33

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার দৃশ্য৷ ১৭ জুলাই বিকেলে৷

আন্দোলন যেভাবে ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাতে শাসকদলের নেতারাও উদ্বিগ্ন। কেবলমাত্র পুলিশ, সেনা দিয়ে আন্দোলন দমাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে কারণ এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানিয়ে গণমানুষের সম্পৃক্ততা ক্রমশ বাড়ছে৷ বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরছে, "স্বৈরাচারী হাসিনার পতন ঘটাও, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও৷" সেকারণে আন্দোলনের রাস্তাও খোলা রাখতে চাইছে সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা আলোচনার রাস্তায় আসবেন কি না সেটাই এখন দেখার।

0:00
/0:29

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে পুলিশ ও ছাত্রলীগ৷ ১৭ জুলাই সন্ধ্যায়৷ যখন এই হামলা চলছিল, ঠিক তখনই টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছিলেন, "আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যা ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল। তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।" জনমনে সংশয় উঠেছে, "শেখ হাসিনার দলের ছাত্রসংগঠন 'ছাত্রলীগ'ই তো এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে দেশজুড়ে, হাসিনার হুকুমেই তো পুলিশ এত এত আন্দোলনকারীর ওপর গুলি চালাচ্ছে৷ তাহলে উনিই সন্ত্রাসীদের রক্ষা করছেন আবার বিচারের কথা বলে নাটক করছেন, মানুষ নিয়ে খেলছেন