একটি বই বদলে দিল একটি জাতির ভবিষ্যত!
নিজস্ব সংবাদদাতা : বাংলায় শিয়ালগিরি জাতির আবির্ভাব মেদিনীপুরের সীমানায়।বাংলায় শিয়ালগিরি জাতির আবির্ভাব মেদিনীপুরের সীমানায়।বাংলা-ওড়িশা সীমানার নিমপুরে আয়োজিত এক সভায় এলাকায় বসবাসকারী বিশেষ-অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজনেরা 'শিয়ালগিরি' সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন । সভায় উপস্থিত ছিলেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান, দাঁতন ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কনক পাত্র, গবেষক তথা শিয়ালগিরি আন্দোলনের মুখপাত্র সন্তু জানা, আন্দোলনের সভাপতি ভজহরি পাত্র, গিরিশ পাত্র, শিক্ষক শিবশঙ্কর সেনাপতি সহ প্রায় শতাধিক শিয়ালগিরি মানুষজন ।"শিয়ালগিরি" ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিরলতম সম্প্রদায় বা জনজাতির নাম । প্রায় ২৫০ বছর ধরে সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে এই যাযাবর শ্রেণির মানুষেরা কেবলমাত্র মেদিনীপুর জেলায় বাস করত । আজও দক্ষিণবঙ্গের ওড়িশা-সীমানায় অবস্থিত দাঁতন ও মোহনপুর থানায় এদের বসতি। সীমানা পেরিয়ে ওড়িশার বালিয়াপাল, ভোগরাই ও সুগো অঞ্চলেও এদের আত্মীয় স্বজনের বসবাস । যোগেশচন্দ্র বসুর মতো ইতিহাসবিদের অনুমান, এরা মারাঠা বর্গীদের বংশধর । আবার ও' ম্যালি সাহেবের বিচারে এরা গুজরাট-মধ্যপ্রদেশ সীমানার 'ভিল' জনজাতির একটি ভবঘুরে শাখা । মেদিনীপুরের এমন অপরিচিত মানুষজনের কথা আজও অনালোকিত । অথচ ভারতের সম্প্রতিক সেন্সাস রিপোর্ট অনুসারে জানা যায়, শিয়ালগিরি সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০০০ মানুষ এখনও কেবল বাংলা-ওড়িশা সীমানায় বসবাস করে !অতীতে একসময় nomadic tribe শিয়ালগিরিরা নানাবিধ বন্যপশুর কাঁচা মাংস খেত, শিকার করত অরণ্যের গভীরে গভীরে, চুরি করে দিন গুজরান করত । ১৯৫১ সালে census of west bengal এ এদের unclean feeders বা "ম্লেচ্ছ ভক্ষণকারী" জনজাতি হিসেবে সর্বনিম্ন তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল । এদের সঙ্গী ছিল, ডোম, চামার, কোড়া প্রভৃতি।এক অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতো দাঁতন-মোহনপুর থানার শিয়াল গিরিরা ।
অনেক গুজরাটি অপভ্রংশের সমাহার দেখা সেই ভাষায় :
"Ek maradna bay dikra thei. Tinhe biche nanhe dikra apnu babane kahe, bab maro hinch mar de..."। অর্থাৎ, একটি লোকের দুটি ছেলে ছিল। ছোট ছেলেটি নিজের বাবাকে বললো, বাবা, আমার সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দাও । কিন্তু, এই ভাষায় আর বেশিদিন কথা শোনা যাবে না । গুটিকয়েক বৃদ্ধের মুখেই কোনপ্রকারে বেঁচে আছে প্রাচীন কথ্যভাষাটি। নবীন প্রজন্মের অনাগ্রহে ভাষাটি ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে । শিয়ালগিরি সম্প্রদায় নিজেদের হিন্দু বলে দাবি করে, কিন্তু মৃতদেহ চিতায় ওঠে না, বরং কবরে যায় । কোন প্রতিষ্ঠিত মন্দির-মসজিদ এদের কিছুই প্রায় নেই । বরং বাড়ির এক কোণে কলসিতে সিঁদুর লাগিয়ে এরা বংশপরম্পরায় প্রেত পুজো করতেন । শিয়ালগিরিদের লৌকিক জীবন সত্যিই বিস্ময়কর ।১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ ভাষাবিদ গ্রিয়ার্শন সাহেব প্রথম এদের খোঁজ পেয়েছিলেন দাঁতন থানায় । তারপর, সুবর্ণরেখা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে । যাযাবর অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সামাজিক হয়ে গিয়েছেন এরা। সমাজজীবন ও খাদ্যাভাসে এসেছে বহুল পরিবর্তন । এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের লোকায়ত সংস্কৃতি, রীতি ও ভাষা ভুলে গিয়েছেন বেমালুম । একশো বছর আগে থেকেই নিজেদের পদবী পরিবর্তন করে হয়েছিলেন দাস, পাত্র, জানা, বারিক প্রভৃতি । বর্তমানের শিয়ালগিরি অতীতের ফসিল মাত্র । এমন একটি বিলুপ্তপ্রায় জনজাতিকে বাঁচাতে হলে দরকার ছিল শেকড়ের অনুসন্ধান। অবশেষে, ২০১৬-১৭ সাল থেকে দাঁতনের গবেষক সন্তু জানার আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে শুরু হয়েছিল শেকড়ের অনুসন্ধান। ভারতবর্ষের এমন বিরল এক জনজাতির মানুষের আবছা ইতিহাস, লোকায়ত জীবন, ধর্ম, ভাষা, শিক্ষা, সমাজজীবনের কথা, আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে একটি আকর গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তিনি চলতি বছর কলকাতা বইমেলায়। ফলে, শিয়ালগিরিরা প্রথম জানতে পেরেছে তাদের অতীত ইতিহাস। নিজেদের অজ্ঞানে নিজ জাতিকে সাঁওতাল-শবর ভেবে দীর্ঘ পাঁচ-ছয় দশক ধরে এরা দাবি করে আসছেন "শবর" পরিচয়পত্র লাভের । কিন্তু প্রমাণের অভাবে বারংবার তা নাকচ হয়ে গিয়েছে। অবশেষে, গবেষক সন্তু জানার গবেষণাগ্রন্থটিকে নিজেদের একমাত্র "ধর্মগ্রন্থ" মনে করে, নিমপুরে আয়োজিত ঐতিহাসিক বৈঠকে তারা "শিয়ালগিরি " রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন । পশ্চিম বঙ্গের মানচিত্রে আবির্ভাব হলো নতুন একটি জনগোষ্ঠীর। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক বলেছেন, "সন্তু জানাদের মতো কেউ কেউ যদি দেশীয় ভাষায় এমন একটি লুপ্ত প্রায় জনজাতির ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন, তাদের মুখের ভাষা থেকে শব্দ, বাক্য সংগ্রহ করে রাখেন, তাদের জীবনশৈলীর বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেন — তবে সেটি সবার আগে সেই জনজাতির সৌভাগ্য ।" প্রসঙ্গত জানা যায়, ২০১৭ সালে ওড়িশা সরকার আন্দোলনকারী শিয়ালগিরিদের মান্যতা প্রদান করে তপশিলি জাতির তালিকাভুক্ত করেছেন। এবার বাংলার কয়েক হাজার শিয়ালগিরিদেরও দীর্ঘলালিত স্বপ্নপূরণের দিন গোনা শুরু হলো।