বিয়ের পরেই মেয়েদের খেলা ছাড়তে হয় - শ্রীপর্ণা নন্দ
নিজস্ব সংবাদদাতা : ২২ বছর বয়সে বিশ্বজয় করে লাইমলাইটে শিলিগুড়ির মেয়ে রিচা ঘোষ। তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সারা বাংলা। ফুটবল , ক্রিকেট, টেনিস , ব্যাডমিন্টন , দাবা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রান্ত খেলাগুলির পৃথিবীজুড়ে একই নিয়ম। কিন্তু ইকির -মিকির , ডাংগুলি , বউ -বসান্তি , কানামাছি , চোর -পুলিশ , এলাটিং বেলাটিং , কিত্কিত্, ধাপসা , ঘুটিং প্রভৃতি গ্রামবাংলার খেলাগুলি এক -এক অঞ্চলে এক -এক রীতিতে চলে। এক অঞ্চলের নিয়মকানুন অন্য অঞ্চলে মিলতে নাও হতে পারে। এইগুলিই লোকখেলা৷ আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খেলাগুলিও লৌকিক রূপ পায় যখন বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল বা কাঠের তক্তা , তাল বা নারকেল বাগড়ার ব্যাট এবং বাখারির উইকেট বানিয়ে চলে ক্রিকেট খেলা৷ উল্টো ঘটনাও ঘটে৷ হাডু-ডু, খোখো প্রভৃতি গ্রাম বাংলায় প্রচলিত খেলাগুলোকে আধুনিক নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ‘শিষ্টক্রীড়া ’র পর্যায়ে উন্নীত করা হয়৷ মেয়ে শর্টস পরে টেনিস খেলবে, পাতলা গেঞ্জি পরে দৌড়বে- না না, কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। পাড়ার পাঁচ জন যদি ছি ছি করে। একে কালো মেয়ে। জন্মের পরে পরিবারের মুখ পুড়িয়েছে। আদৌ বিয়ে হবে নাকি সারাজীবন আইবুড়ো থেকে ঘর জ্বালাবে, কে জানে! তার উপরে ভোরে উঠে ধেই ধেই করে রাস্তায় দৌড়বে। এ তো হতে পারে না। এই হচ্ছে গড় মানসিকতা!যে বাবা-মায়েরা অন্যদের সাফল্যে হাততালি দেন, পাড়ার চায়ের দোকানে বা ক্লাবে গিয়ে নারী স্বাধীনতা নিয়ে টেবিল চাপড়ান, বাস্তবে তিনিও নিজের মেয়েকে পর্দানসীন রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। তুমি মেয়ে। এটা কোরো না। ওটা কোরো না। তুমি মেয়ে। পাড়ার সবার সঙ্গে মেলামেশা তোমার মানায় না। তুমি মেয়ে। ফাইনালে ওঠার পর সেই বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়েছিল ইউক্রেনের টেনিস খেলোয়াড় লুদমিলা কিচেনককে। তবে বিয়ে স্থগিত রাখা সার্থক হয়েছিল তাঁর। সেই ট্রফি কিন্তু উঠেছিল তাঁর হাতেই। আর এই দেশের বিয়ের পর খেলা ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল ভারতের অন্যতম সেরা নারী ক্রিকেটার মিতালি রাজকে। কিন্তু ক্রিকেট ছাড়তে নারাজ ছিলেন মিতালি। ঠিক তেমনই বিয়ের পর খেলা ছাড়তে রাজি হননি এই বঙ্গের খড়্গপুর শহরের ইন্দা সারদাপল্লির বাসিন্দা টেবল টেনিস খেলোয়াড় শ্রীপর্ণা নন্দ। তিনি জানান, যখনই বিয়ের কথা উঠেছে, খেলা ছেড়ে দিতে হবে বলে পাত্রপক্ষ শর্ত দিয়েছে। তাতে তিনি রাজি হননি। ফলে এখনও বিয়ে করেননি তিনি। খেলার জন্য সব ছাড়তে পারেন। কিন্তু বিয়ের জন্য খেলা ছাড়তে পারবেন না—এমনটাই জানান শ্রীপর্ণা। ন্যাশনাল স্কুল গেমসে টেবল টেনিসে বাংলার কোচ হয়ে একগুচ্ছ সোনা এনে দিয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরি করেন। বছর পঁয়ত্রিশে পা দিলেন। কিন্তু বিয়ে করেননি। তাঁর কাছে টেবল টেনিস খেলা ঈশ্বরের মতো। শ্রীপর্ণা সেই ঈশ্বরকে ছাড়তে নারাজ। শ্রীপর্ণা বলেন, ‘পাত্র পেলাম কই? সরকারি চাকরি করেন এমন পাত্র, আবার আইনজীবী, স্কুল শিক্ষক—এমন মিলিয়ে আট জন দেখতে এসেছিলেন। সবাই পছন্দও করেছিলেন। কিন্তু সবাই একই কথা বলেন বিয়ের পর খেলা ছাড়তে হবে। এ সব কথা শুনলে ভাবি আমরা এখনও কোথায় পড়ে আছি। ‘শিক্ষিত’ শব্দটা কোথায় প্রযোজ্য। তাই বিয়ে ভাঙতে বাধ্য হয়েছি। আমার ধ্যান, জ্ঞান টেবল টেনিস। তেমন পাত্র না পেলে সারা জীবন অবিবাহিত থাকতেও রাজি।’তাঁর জীবনে বিয়ের সানাইয়ের সুর কাটলেও খেলার সুর কাটতে দেননি এক বিন্দুও। শত বাধা পেরিয়ে খেলতে গিয়েছেন দেশ–বিদেশেও। সে সময়ে তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট টেবল টেনিস খেলোয়াড় ও কোচ সুনীল দত্ত। তাঁর হাত ধরে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে টেবল টেনিসে বাংলা দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন চার বার। মেয়েরা আবার কী খেলাধুলা করবে? এ ধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এমন সব চিন্তাধারার কারণেই মেয়েদের খেলাধুলার দুনিয়ায় পা দেয়ার গতিটা অত্যন্ত ধীর।এসবের ফলে খেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের জীবনের প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। সমাজের চোখরাঙানি, পোশাকের ধরন নিয়ে সমালোচনা, প্রতিবেশীদের তিরস্কার ও সামাজিক কুসংস্কারের ভয়ে অনেক অভিভাবক মেয়েদের ক্রীড়াক্ষেত্রে পাঠানোর কথা ভাবতেও পারেন না। এই সব কারণে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাধার সম্মুখীন। আগে নারীর ক্ষমতায়নে ক্রীড়ার ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। নারীদের মাঝে নেতৃত্বগুণ বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের কৌশলগত চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বিকশিত করতে হবে । নেতৃত্বের সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান ও দল পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুণের বিকাশ ঘটাতে হবে। এছাড়া খেলাধুলায় সফলতা অর্জন করার মাধ্যমে নারীরা সমাজে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার পাশাপাশি অন্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করতে হবে।