বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলায় উদ্বেগ অ্যামনেস্টির, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে পুলিশের ভূমিকায় মাঠে ছাত্রলীগ!
ঢাকা জাকির হোসেন : বাংলাদেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর পুলিশের দমন-পীড়নে শত শত পড়ুয়া তথা শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী আহত হওয়ার খবরে উদ্বেগ জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া শাখা বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে উদ্বেগ জানিয়েছে৷ ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়া বলেছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই প্রতিবাদ করার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তা ও অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার বন্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ও নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কোটা বাতিল এবং রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করার দাবিতে পড়ুয়ারা রাস্তা নামতেই উত্তপ্ত হতে থাকে বাংলাদেশ। এই ইস্যুতে ‘বাংলা ব্লকেডে' দেশজুড়ে আন্দোলন করছে পড়ুয়া এবং চাকরিপ্রার্থীরা। নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চলমান আন্দোলনে ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ নানা জায়গায় তাদের পুলিশ বাধা দিলেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নিজেদের দাবিতে অনড় থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত পড়ুয়ারা। তাদের ওপর লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট এবং টিয়ারশেল গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ৷ এতে প্রায় ৭০ জন পড়ুয়া আহত হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিকও৷ আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর৷ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই জাদুঘর সংলগ্ন আনসার ক্যাম্পের সামনে এই সংঘর্ষ হয়৷ আন্দোলনকারীরা জানান, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিকেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ীর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এই নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশকে পড়ুয়ারা জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবেন। পুলিশ তাদের বাধা দিলে তারাও পুলিশকে জবাব দেবেন। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচিতেও বাধা ও লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ৷ ১১ জুলাই বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে টাইগারপাস মোড়ে মিছিল নিয়ে প্রবেশের সময় বাধার সম্মুখীন হয় তারা। বাধা দেওয়ার এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পরে শিক্ষার্থীরা বাধা উপেক্ষা করে রাস্তা অবরোধ করে নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে ২ নম্বর রেল গেইট এলাকার দিকে মিছিল নিয়ে বের হয়। একই দাবিতে আন্দোলনে নামা ঢাকা কলেজের পড়ুয়াদের মিছিলেও বাধা দিয়েছে পুলিশ। পূর্বঘোষিত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই মিছিল বের করা হয়। ১১ জুলাই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকার নীলক্ষেত মোড়ে ওই মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ৷ আন্দোলনকারীরা জানান, ঢাকা কলেজের এই মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। পরে তারা সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হওয়ার খবর এসেছে৷ বরিশাল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ সহ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের ওপর পুলিশি হামলার খবর আসছে৷
পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের চোখের সামনেই আন্দোলনকারীদের দমাতে কাজ করছে শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন 'ছাত্রলীগ' এর নেতাকর্মীরা৷ আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনরত পড়ুয়া ও চাকরিপ্রত্যাশীদের ওপর হামলা ও অনবরত হুমকি-ধমকিতে বহিরাগত সন্ত্রাসীদেরও ভাড়া করে আনছে বলে অভিযোগ আসছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে৷ জনমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, 'ছাত্রলীগ কি সাংবিধানিকভাবে কোনো সামরিক বাহিনী বা পুলিশ? ওরা কোন আইনে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে?' নেটিজেনদের অনেকেই এই সংগঠনটিকে আখ্যা দিচ্ছেন 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদককে জানালেন, "ছাত্রলীগ আমাদের কলেজের হোস্টেল থেকে ছাত্রদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের সাথে শরিক হবার জন্য৷ আশপাশের অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ওরা ছাত্রদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ওদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়াও বাইরে থেকে সন্ত্রাসী ভাড়া করে তাদেরকে সংগঠিত করছে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে৷ এ অবস্থায় আমরা সাধারণ ছাত্ররা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কিত৷" কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, "হাইকোর্টের আংশিক রায়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। হাইকোর্টের আংশিক রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটার সংস্কার করতে পারে। এ বিষয়টিই আজ স্পষ্ট হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন লাঠিচার্জ করা হলো? শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নারী পুলিশ হামলা করেছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করেছে, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে৷ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তারা অতি উৎসাহী। সেই পুলিশদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ছাত্রলীগ আজ পুলিশের সাথে এক হয়েছে৷ আমরা মনে করি, এতে সরকার নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। আপনারা এতদিন আমাদের বলেছেন, আদালতের প্রতি ভরসা রাখতে। এখন আদালত আপনাদের দায়িত্ব দিয়েছে সেটি আপনারা পালন করুন। তা না করে আপনারা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে৷"
এদিকে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে ১২ জুলাই শুক্রবারও ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ১১ জুলাই সারাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানান৷ ১২ জুলাই বিকেল চারটা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এক ঘণ্টা পর বিকেল পাঁচটায় মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা কলাভবন, লেকচার থিয়েটার ভবন ঘুরে উপাচার্য চত্বর হয়ে রাজু ভাস্কর্যে হয়ে ফের শাহবাগ অবরোধ করেন। এ সময় তারা স্লোগান দেন- ‘লাঠিচার্জ-টিয়ারগ্যাস, জবাব দেবে বাংলাদেশ’, ‘হামলা করে আন্দোলন, পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’ প্রভৃতি। আন্দোলনের সমন্বয়ক হামজা মাহবুব বললেন, "সারাদেশে ভাইবোনদের হামলা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় গুলি করা হয়েছে। আর যদি গুলি চলে তাহলে এই শাহবাগে জবাব দেওয়া হবে।" অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই শাহবাগের মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে অবস্থান নিয়ে মানবপ্রাচীর তৈরি করেন৷ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেননি তবে পুলিশের সামনে গিয়ে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবি হলো- ‘সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে শুধু পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) রেখে কোটা সংস্কার করতে হবে।' ২০১৮ সালে তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। ২০২১ সালে ওই পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশ নিয়ে হাইকোর্টে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন হাইকোর্ট পরিপত্রটি বাতিল করে। রায়টি আপিল বিভাগেও বহাল রাখা হয়। পরে দুই শিক্ষার্থীর রিটে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা দেয়। তবে শিক্ষার্থীরা এক দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ১২ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট নাগাদ অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ১৩ জুলাই শনিবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান সমন্বয়করা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ঐক্যের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বকর মজুমদার বলেন, ১৩ জুলাই শনিবার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলায় অনলাইন-অফলাইনে প্রতিনিধি বৈঠক হবে। এরপর সন্ধ্যা ছ'টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।