বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন অধ্যাপক ড. ইউনূস ও ১৬ জন উপদেষ্টা!

ঢাকা, জাকির হোসেন: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন ১৬ জন৷ ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ পাঠ করান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন৷ এর আগে দুপুর ২টা ১১ মিনিটে ড. ইউনূসকে বহনকারী ফ্লাইটটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় বিমানবন্দরে ড. ইউনূসকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনীর প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা৷ নিয়োগ পাওয়া ১৬ জন উপদেষ্টা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ, মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর আ ফ ম খালিদ হোসেন। এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের' সমন্বয়কদের মধ্যে দুইজন উপদেষ্টাদের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন - নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া৷ নিয়োগ পাওয়া ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে ১৩ জন শপথ নিয়েছেন। ঢাকার বাইরে থাকায় তিনজন শপথ নিতে পারেননি। তবে তাঁদের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। তাঁরা হলেন- বিধান রঞ্জন রায়, ফারুক–ই–আজম ও সুপ্রদীপ চাকমা। শিগগির তাঁরা শপথ নেবেন বলে জানা গেছে।

এদিকে নতুন সরকারের শপথ নেওয়া প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "নতুন বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন বিজয় দিবস শুরু করল। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটি করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, তারা (সমন্বয়কেরা) দেশকে রক্ষা করেছে। দেশকে পুনর্জন্ম করেছে।" এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "আজকে আমার আবু সাঈদের (রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) কথা মনে পড়ছে। অবিশ্বাস্য একটা সাহসী যুবক। যে আবু সাঈদের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁধে আছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে।" এই কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূস কেঁদে ফেলেন৷ ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফিরে মুহাম্মদ ইউনূস হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসব কথা বলেন৷ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় ফিরে তাঁর প্রথম বক্তব্যে বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই হবে তাঁর প্রথম কাজ। কারও ওপর কোনো হামলা যাতে না হয় সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি বলেছেন, "আমার ওপর আস্থা রাখুন, ভরসা রাখুন, দেশে কারও ওপর কোনো হামলা হবে না।" তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, "এ স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে।" মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "দেশবাসী, আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, দেশে কারও ওপর কোনো হামলা হবে না।" অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি মানুষের কাছে এর সুফল পৌঁছে দিতে হবে। স্বাধীনতার অর্থ হলো, দেশ তোমাদের হাতে। তোমাদের মনের মতো করে গড়তে পারো। পালটে ফেলতে পারো। পুরনোদের বাদ দাও। তোমাদের মধ্যে সৃজশীলতা আছে, তাকে কাজে লাগাও।" তিনি আরও বলেন, "সরকার (শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার) হয়ে উঠেছিল দমনপীড়নের একটি যন্ত্র। এটা সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষ উৎফুল্ল হবে, যে সরকার মানুষকে রক্ষা করবে। সারা বাংলাদেশ একটি পরিবার।"

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। সবাইকে রক্ষা করা আমাদের কাজ। প্রতিটা মানুষ আমাদের ভাই। বিশৃঙ্খলা অগ্রগতির বড় শত্রু। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের প্রথম কাজ।"

উল্লেখ্য, গত পহেলা জুলাই থেকে রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে পড়ুয়া তথা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নির্দেশে তার মদতপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসীদল ছাত্রলীগ দেশজুড়ে আট হাজারের বেশি ছাত্র ও সাধারণ মানু্‌ষকে হত্যা করে৷ ২২ হাজার মানুষ তাদের হামলায় আহত হয়৷ এর প্রতিবাদে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে৷ এই আন্দোলনের পথ ধরে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা৷ শেষ হয় ১৬ বছরের নৃশংস এক স্বৈরাচারী অধ্যায়ের৷

শপথ নিচ্ছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস