বাংলাদেশে হিন্দু বৃদ্ধা মালতী রানীর শেষ সম্বল জমিটুকুও দখলবাজের কবজায়!

ঢাকা, জাকির হোসেন: স্বামী তারক দেবনাথের মৃত্যুর পর মালতী রানী নাথ মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন নিজের কেনা একখণ্ড জমি৷ সেই জমিটুকুও দখলে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা৷ মাথা গোঁজার এই ঠাঁই ফিরে পেতে আদালতের দ্বারস্থ হন৷ বছরের পর বছর ধরে সেই আদালতের দরজাতেই দিন কাটাচ্ছেন আশি বছরের এই বৃদ্ধা৷ এখনও অবধি পাননি বিচার৷ অসহায় কাঁপা কণ্ঠে বললেন, 'আর কতকাল বেঁচে আছি জানি না৷ জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছি বাবা৷ ভগবান এটাই কপালে লিখেছিলেন৷' মালতী রানীর নিবাস বরিশালের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চকবাজার এলাকার৷ ঘটনার বিবরণে জানা যায়, চকবাজার এলাকার বাসিন্দা ছিলেন মনীন্দ্র কুমার ও রাজেন্দ্র কুমার৷ সম্পর্কে তারা আপন দুই ভাই৷ মনিন্দ্র কুমার অবিবাহিত থাকাবস্থায় মারা গেলে তার জমির অংশ পান ভাই রাজেন্দ্র কুমার৷ রাজেন্দ্র কুমার মারা গেলে তার সম্পদের মালিক হন রাজেন্দ্র'র পুত্র শংকর কুমার রায় চৌধুরী৷ তার থেকে মালতী রানী নাথ ২০০৩ সালে ৬৭৬৯ নম্বর সাবকবলা দলিল মূলে সাড়ে চার শতাংশ জমি ক্রয়সূত্রে মালিক হন৷ এদিকে মালতী রানীর কেনা ওই জমির সাথেই রাজেন্দ্র কুমারের ভাড়াটিয়া ছিলেন সুনীল কুমার সাহা৷ সুনীল কুমার দাবি করে বসেন, ১৯৪৩ সালে তিনি ওই জমি কেনার জন্য মৌখিক পত্তন নিয়েছিলেন৷ আদতে সুনীলের এই দাবি ছিল ভূয়া৷ কারণ সুনীল কুমার সেই জমির এসএ খতিয়ানে ১৯৪৩ সাল দেখালেও এসএ খতিয়ান চালুই হয় ১৯৬৩ সালে৷ সুনীলের এই দাবির বিপরীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হচ্ছে, ভূয়া ডিক্রি জারির মাধ্যমে তিনি জমির পত্তন দেখান ১৯৪৩ সালের ২৮ এপ্রিল, অথচ সুনীলের জন্মই হয়েছে ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই! এই নিয়ে ২০০৪ সালে মালতী রানী বাদী হয়ে সুনীল কুমার সাহাকে বিবাদী করে প্রথম দেওয়ানী জেলা যুগ্ম জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন৷ সেই মামলায় নিশ্চিতভাবে হেরে যাবেন এমন শঙ্কায় স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ওই এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান ও তার ভাইদের সাথে যোগসাজশে সুনীল কুমার জমিটির ১ দশমিক এক শূন্য শতাংশ তাদের কাছে বিক্রি করে দেন৷ এরপর ২০১৩ সাল থেকে সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান ও তার ভাই সৈয়দ কামাল হোসেন আমমোক্তার মূলে নিজেদের ওই পুরো জমির মালিক দাবি করে বসেন৷ এরপর সুনীলের থেকে ভূয়া দলিলে ক্রয়সূত্রে জমির মালিক হিসেবে ২০০৪ সালে সুনীলকে বিবাদী করে মালতী রানীর করা মামলায় সুনীলের পক্ষে অন্তর্ভুক্ত হন নোমান ও তার ভাই কামাল৷ তখন ওই জমির ওপর হাইকোর্টের স্থিতাবস্থা বহাল ছিল৷ এখনও মামলা চলমান আছে৷ জমিটি নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর মালতী রানী সেনাবাহিনীর কাছে অভিযোগ করলে তাদের প্রতিনিধি সরেজমিনে জমিটি পরিদর্শন করেন৷ চকবাজার এলাকাতে অভিযোগ রয়েছে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের দাপট দেখিয়ে এলাকাতে অবৈধভাবে একাধিক জমি, স্থাপনা দখল করেছেন নোমান ও তার ভাইয়েরা৷ ওই এলাকাতে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না৷ এদিকে চাঁদাবাজি সহ বিভিন্ন অভিযোগে ঢাকা থেকে নোমানকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷ এখন রয়েছেন জেলহাজতে৷ গ্রেফতারের আগেও মালতী রানীর জমির ওপরে এককোণে থাকা তার জামাতা বাবুল দেবনাথের দোকানে দলবল নিয়ে চাঁদাবাজি ও দখল করতে গিয়েছিলেন নোমান৷ এমনকি নোমানের ভাইয়েরা তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সম্প্রতি বরিশাল নগরীতে হওয়া মানববন্ধনে এলাকার বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে জোর করে হাজির করেছিলেন৷ গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নোমান ও তার ভাই চকবাজার এলাকার সদ্য অব্যাহতি পাওয়া কাউন্সিলর সৈয়দ হুমায়ুন কবির লিংকু৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে দেশের সকল সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের তাদের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়৷ অভিযোগ, বিগত হাসিনা সরকারের আমলেও নোমান ও তার ভাইদের লুটতরাজের ধারা অব্যাহত ছিল৷ গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারাও এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র সমর্থক হয়ে গেছে৷ এর পূর্বে যখন বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তখন নোমান ও তার ভাইয়েরা দলটির বরিশাল অঞ্চল কমিটির বিভিন্ন পদে আসীন ছিল৷ কিছুদিন আগেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্নীতি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন এবং এরকম কাজে কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দলগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ও দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে৷ এরই ধারায় এবার বিপাকে পড়েছেন দখলবাজ নোমান ও তার ভাইয়েরা৷ যুগের পর যুগ যাচ্ছে৷ মালতী রানী দিন গুনছেন তার কেনা শেষ সম্বলটুকুতে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে নিশ্বাস ফেলতে৷ জীবন সায়াহ্নে এসে প্রায় নিঃস্ব অশীতিপর এই বৃদ্ধা শুধু মানবেতর দিনযাপন করছেন তা-ই নয়, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কবে দখলদার সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয় এই আশঙ্কায় -এমনটাই জানালেই এই প্রতিবেদককে৷