বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের দপ্তর বণ্টন, কে কোন দপ্তর পেল!

ঢাকা, জাকির হোসেন: বাংলাদেশের নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের ১৬ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন মন্ত্রক ও বিভাগের দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে। ৯ আগস্ট শুক্রবার দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।

ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, খাদ্য, ভূমি মন্ত্রকসহ মোট ২৭টি মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেইসাথে ১৩টি মন্ত্রকের দায়িত্ব আরো ১৩ জন উপদেষ্টার মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। এরমধ্যে তৌহিদ হোসেন পেয়েছেন বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল অবধি তিনি বাংলাদেশের বিদেশ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তৌহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল অবধি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিযুক্ত হন৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অবধি টানা পাঁচ বছর বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নির্বাচন বিশ্লেষক হিসেবে তার লেখা বা উপস্থিতি দেখা যায়। সেইসাথে ভূ-রাজনীতি প্রসঙ্গেও তার প্রচুর কলাম রয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ৷ তিনি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আদিলুর রহমান খান পেয়েছেন শিল্প মন্ত্রকের দায়িত্ব৷ আদিলুর রহমান খানকে ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ বিতর্কিত একটি অভিযোগে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল হাসিনা সরকার৷ পরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ আদালতের সেই কারাদণ্ডের রায়ে হস্তক্ষেপ করে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার, এমন অভিযোগ ওঠে তখন৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছিল তখন৷ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসান আরিফ পেয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রকের দায়িত্ব। তিনি ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রকেরও উপদেষ্টা ছিলেন। তারও আগে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল অবধি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সরব সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান পেয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের দায়িত্ব। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি 'বেলা'র প্রধান নির্বাহী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ‘রামোন ম্যাগসেসে’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন এস মুরশিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন। নির্বাচন বিশ্লেষক ছাড়াও তিনি ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতার বিষয়ে বেশ আগে থেকেই সরব। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আখতার। তিনি বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’র (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক। তিনি একাধারে মানবাধিকার, সেইসাথে বিকল্প কৃষি উৎপাদন ও গবেষণা এবং নারী অধিকার বিষয়ক একজন কর্মী। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর এবং ইসলামী চিন্তাবিদ আ ফ ম খালিদ হোসেন পেয়েছেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রকের দায়িত্ব। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি একজন ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক৷ গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন৷ তারা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নাহিদ ইসলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন৷ অন্যদিকে, আসিফ মাহমুদ ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা দুজন এর সমন্বয়ক হিসেবে নেতৃত্বে দিয়ে আসছে। এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, শিক্ষা, সড়ক পরিবহন ও সেতু, খাদ্য, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, ভূমি, বস্ত্র ও পাট, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রেলপথ, জনপ্রশাসন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, নৌ-পরিবহন, পানি সম্পদ, মহিলা ও শিশু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, তথ্য ও সম্প্রচার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান, সংস্কৃতি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, মুক্তিযুদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা- এই ২৭টি মন্ত্রক দেখবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷

ইতিমধ্যে এ সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের দিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বহু নেতা উপস্থিত ছিলেন বঙ্গভবনে৷

এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনগণ প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো উপায়ে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে রাষ্ট্রসংঘ। নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থার মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হক এ কথা বলেছেন৷ ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কি না বা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কি না। জবাবে রাষ্ট্রসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র বলেন, "তিনি (মহাসচিব) তাঁর (ড. ইউনূস) সঙ্গে কথা বলেননি৷ তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত আবাসিক সমন্বয়ক আজকের (বৃহস্পতিবার) শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যেন শান্তিপূর্ণ হয়, তা নিশ্চিত করতে তিনি ও কান্ট্রি টিম সক্রিয় রয়েছে।"

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যোগাযোগ হয়েছে বলে জানিয়েছে আমেরিকার বিদেশ দপ্তর। স্থানীয় সময় ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এ কথা জানান। তিনি বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে নিজেদের চাওয়ার কথা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধের জন্য ড. ইউনূসের আহ্বানকেও আমেরিকা স্বাগত জানিয়েছে।" ম্যাথিউ মিলার বলেন, "আমাদের চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স আজ (বৃহস্পতিবার) শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং আমরা সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধের জন্য ড. ইউনূসের আহ্বানকে স্বাগত জানাই। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার এবং ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।"

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে চলে যান স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর নেতৃ‌ত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ক‌রা হয়েছে বাংলাদেশে৷