প্রয়াত পথের পাঁচালীর উমা দাশগুপ্ত!
নিজস্ব সংবাদদাতা : অপু-দুর্গা আমাদের শৈশবের, কৈশোরে, যৌবনের প্রিয় নাম। ভালোবাসার নাম, শ্রদ্ধার নাম। বিশ্বাস করি, 'বাংলা সংস্কৃতি যতদিন, অপু দুর্গা ততদিন।সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’তে দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করে যিনি অমর হয়ে আছেন, সেই কিংবদন্তি অভিনেত্রী উমা দাশগুপ্ত আর নেই। সোমবার সকালে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি।উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন অভিনেতা-সাংসদ চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। তিনি জানিয়েছেন, অভিনেত্রীর মেয়ে তাঁকে এই দুঃসংবাদটি জানিয়েছেন। উমা দাশগুপ্ত যে আবাসনে থাকতেন, চিরঞ্জিৎও সেখানেই থাকেন। তিনি জানিয়েছেন যে অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এর আগেও একবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এবার আর রক্ষা হল না।উমা দাশগুপ্তের জীবন ছিল নানা ঘটনায় ভরপুর। ১৯৫৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। তাঁর স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, যিনি সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু ছিলেন, তিনিই উমার নাম প্রস্তাব করেন।
যদিও উমার বাবা চাননি যে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করুন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় তাঁর পরিবারকে রাজি করিয়ে নেন। ‘পথের পাঁচালী’তে দুর্গার মৃত্যু দৃশ্য শুধু অপুর মনেই নয়, সমগ্র দর্শকমহলকে কাঁদিয়েছিল।
উমা দাশগুপ্ত শুধু অভিনেত্রী হিসেবেই নয়, একজন লেখিকা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখায় ভারতীয় সমাজের নানা দিক ফুটে উঠেছে। তিনি নারীদের জীবন ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের সম্মুখীন হওয়া চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে লিখেছেন। আধুনিকতার প্রভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও রীতিনীতির পরিবর্তন নিয়েও তিনি লিখেছেন।
উমা দাশগুপ্তের লেখনীতে ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য ও জটিলতা ফুটে উঠেছে। তাঁর গল্পগুলি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ‘দ্য পুজা’ গল্পে দুর্গাপূজার প্রস্তুতির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যা বাঙালি সংস্কৃতিতে এই উৎসবের গুরুত্ব তুলে ধরে। উমা দাশগুপ্তের লেখা শুধু সাহিত্যের জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন। দ্য স্টেটসম্যান, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য টেলিগ্রাফ – এই সব প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রে তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখায় রাজনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদন – নানা বিষয় স্থান পেয়েছে।
উমা দাশগুপ্তের লেখায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। তিনি লিঙ্গ সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘মাই স্টোরি’ বইতে তিনি নিজের পারিবারিক সহিংসতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যার মাধ্যমে দেশের অসংখ্য নারীর দুর্দশা তুলে ধরেছেন। উমা দাশগুপ্তের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল ‘দ্য প্রাইস অফ সল্ট’। এই উপন্যাসে একজন তরুণী একজন বয়স্ক মহিলার প্রেমে পড়ার গল্প বলা হয়েছে। সমকামী সম্পর্কের এই অগ্রগামী চিত্রায়ন LGBTQ চরিত্রদের সংবেদনশীল উপস্থাপনার জন্য প্রশংসিত হয়েছে। উমা দাশগুপ্তের লেখায় লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে জাতি, শ্রেণী ও যৌনতার মতো অন্যান্য পরিচয়ের সংমিশ্রণ দেখা যায়। তিনি স্বীকার করেছেন যে লিঙ্গ একটি পৃথক বিভাগ নয়, বরং একজন ব্যক্তির জীবনের অন্যান্য দিকগুলির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
উমা দাশগুপ্তের লেখা ভারতীয় সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর রচনা অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিষয়বস্তু, জীবন্ত চিত্রকল্প ও কাব্যিক ভাষার জন্য পরিচিত। তাঁর গল্পগুলি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সম্মুখীন হওয়া চ্যালেঞ্জগুলির একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
উমা দাশগুপ্তের লেখা আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর গল্পগুলি ভারতে নারীদের জীবনের একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, বিশ শতকের মধ্যভাগের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি ঝলক দেয় এবং দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। তাঁর রচনাগুলি নারীদের সহনশীলতা এবং সামাজিক প্রথা থেকে মুক্ত হওয়ার তাদের সংকল্পের সাক্ষ্য। উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর অভিনয় ও লেখনী দুটোই বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ‘পথের পাঁচালী’র সেই ছোট্ট দুর্গা চিরকাল বাঙালি দর্শকের মনে জীবন্ত থাকবে। উমা দাশগুপ্তের প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগৎ হারাল একজন প্রতিভাবান শিল্পীকে।