খড়গপুর 'গোপালী আশ্রমের ' সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের সমাপন অনুষ্ঠান!

সমীরণ ভৌমিক : মানব সেবা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সেবা প্রকল্প পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর 'গোপালী আশ্রম'। এই গোপালী আশ্রমে সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের সমাপন অনুষ্ঠান ও সেবা কুম্ভ ' ২০২৫ অনুষ্ঠিত হলো গত ৫ ই অক্টোবর '২০২৫, রবিবার, বিকাল ৪:৩০ টায়, হাওড়া ময়দানের, হাওড়া ' শরৎ সদন ' পেক্ষাগৃহে। এই গোপালী মানবসেবা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য নিপীড়িত ও বঞ্চিতদের সেবা করাই প্রধান লক্ষ্য। এই গোপালী সেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা কর্মশালা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এই আশ্রমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন মনোজ কুমার সিংহ (IRTS) & GGM Of IRCTC, পূর্ব ভারত প্রধান, ভারত সরকার। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন  আইআইটি খড়গপুর অধিকর্তা,অধ্যাপক তথা বিজ্ঞানী ড. সুমন চক্রবর্তী,রমাপদ পাল কলকাতা ক্ষেত্র প্রচারক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ,নির্গুণানন্দজী মহারাজ, কেন্দ্রীয় মার্গ দর্শক মন্ডলীর সদস্য,বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, গিরিধারী লাল কেষান,(সভাপতি, মানব সেবা প্রতিষ্ঠান) , দিলীপ কুমার ঝাওর, সম্পাদক, মানবসেবা প্রতিষ্ঠান, নন্দলাল লোহিয়া, মার্গদর্শক, মানব সেবা প্রতিষ্ঠান,নটবর লাল বঙ্গ, সম্পাদক,কেশব সেবা কেন্দ্র, হাওড়া,সুধাংশু শেখর পাত্র (প্রান্ত সেবা প্রমুখ) বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী,স্বপন মুখার্জি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেবার সর্বভারতীয় সহ সেবা প্রমুখ, বর্তমান কেন্দ্র প্রয়াগরাজ উত্তর প্রদেশ। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায়,( রসায়ন বিভাগ) কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়,প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (দক্ষিণবঙ্গ)। এছাড়াও মঞ্চে আরো বিশিষ্ট গুণীজনদের উপস্থিতি ছিল। প্রথমে ভারত মাতা এবং দুর্গতিনাশিনী দুর্গা মায়ের চরণে পুষ্প দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন মঞ্চে উপবিষ্ট গুণীজনেরা। তারপরে একে একে মঞ্চে উপবিষ্ট বিশিষ্ট গুণীজনদের ব্যাচ, চন্দনের ফোঁটা এবং উত্তরীয় পরিয়ে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়।

অনুষ্ঠান শুরুতে খড়গপুর গোপালী আশ্রমের দিব্যেন্দু চক্রবর্তী (পালক) খুদে কচিকাঁচা, ফুলের মত পবিত্র শিশুদের নিয়ে মানবকল্যাণ সমিতির সবাই মিলে দেশাত্মবোধক কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গান 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা'গানটি পরিবেশিত করেন। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফক্ সিঙ্গার ও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বেতার শিল্পী স্বপন মুখোপাধ্যায়। যিনি মঞ্চে ' ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো 'এই গানটি তাঁর সুললিত কন্ঠে সকল গুণীজন এবং দর্শকদের মন্ত্র মুগ্ধ করেছিলেন। মঞ্চে প্রথম বক্তব্য রাখার জন্য আহবান করা হয় প্রধান অতিথি মনোজ কুমার সিংহ (IRTS) GGM Of IRCTC (পূর্ব ভারত প্রধান), ভারত সরকার। তিনি হিন্দি ভাষায় মঞ্চে উপবিষ্ট পূজনীয় নির্গুণানন্দজী মহারাজকে প্রণাম ও মঞ্চে উপবিষ্ট বিশিষ্ট গুণীজনদের প্রণাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা এবং দর্শকদের, সেই সাথে ছোটদের বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা, ভালোবাসা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন 'যে ধর্মকে রক্ষা করেন ধর্ম তাঁকে রক্ষা করেন '। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর 'গোপালী আশ্রমের' বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কার্যকলাপ ও মানব কল্যাণ, মানব সেবা, তাঁদের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে তাঁর সুললিত বক্তব্য রাখেন। আইআইটি খড়গপুর অধিকর্তা,অধ্যাপক তথা বিজ্ঞানী ড. সুমন চক্রবর্তী বলেন আজকে আমাদের অত্যন্ত একটি গর্বের দিন যে আমরা এই ৫০ বছর যেটা আমাদের প্রত্যেকের অতি প্রিয় ও পরিচিত 'গোপালী আশ্রম'পূর্ণ করেছে তার একটা উৎসব বা সাফল্য সবাই মিলে উদযাপন করছি। এই 'গোপালী আশ্রম' বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, IIT খড়গপুরের কাছে তার থেকে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমরা প্রত্যেকে যেটা বুঝি যে ধর্মের সবচেয়ে গভীর রূপ হচ্ছে সাধনা। সেই সাধনার কোন নির্দিষ্ট ঈশ্বরের রূপ বহন করে তা নয় সেই সাধনা মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে ঈশ্বরের দিকে ধাপে ধাপে নিয়ে যায়। এই সাধনা বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে করেন। এক প্রকার খুব গুরুত্বপূর্ণ সাধনা হচ্ছে সরাসরি ঈশ্বরের পূজা করা কিন্তু বহু মানুষ আছেন যারা অন্যরকম ভাবে মানুষের সেবা করে থাকেন। স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছিলেন ' বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর- জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর '। মানব সেবা একটি নিঃস্বার্থ কাজ।এটাকে দান বা দয়া বলে এই কাজকে ছোট করা যায় না।

'গোপালী আশ্রম ' ও 'আই আই টি ' খড়গপুর এদের দুজনের পথ চলা দুটো ভিন্ন পথের হলেও এই 'মানব সেবার' নিরিখে কিন্তু দুটোর মধ্যে একটা মিল রয়ে গেছে।IIT ( KHARAGPUR) পশ্চিম মেদিনীপুর,আজকের ৭৫ বছরে পা দিয়েছে। সেখানে পরিষ্কার আমাদের যে মূল Main Building তার সামনে লেখা আছে :-' Dedicate the service of the Nationn অর্থাৎ আমাদের জাতীয় সেবায় উৎসর্গীকৃত। আইআইটি, খড়গপুর কিভাবে জাতিকে সেবা করতে পারে? আইআইটি জাতিকে সেবা করতে পারে তার জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি দিয়ে। মানুষের যে স্বাভাবিক প্রয়োজন, যে সমস্যা গুলোকে দূরীভূত করার জন্য। সেটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য যে জরুরি বিষয়গুলো যে জরুরি বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলতে মানুষকে শেখায়। 'গোপালী আশ্রম'যে নিষ্কাম ও নিঃস্বার্থ সেবার উপর ভিত্তি করে আজকে ৫০ বছর পূর্ণ করেছে আমার মনে হয় আইআইটি খড়গপুর তার যে জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বিভিন্ন কাজকর্ম সেগুলোকে আরো ভালোভাবে বিস্তার করতে পারে যাতে গোপালী আশ্রমের হাত ধরে আশেপাশের যে সাধারণ মানুষ ও ছেলে-মেয়েদের সবার জীবনের মান উন্নয়ন সম্ভব হয়। আমার মতে সেটাই হবে আমার ব্যক্তিগতর পক্ষ থেকে ও আইআইটি খড়গপুরের পক্ষ থেকে এই মানবসেবার যে কাজকর্ম ও মানবসেবার উৎসব তাকে সঠিকভাবে সম্মান জানাতে। আইআইটির অধিকর্তা হিসাবে আমার সর্বদাই চেষ্টা থাকবে যাতে আই আই টি খড়গপুর বেশ কিছু কাজকর্ম করে যাতে 'গোপালী আশ্রমের' মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং মানুষের যে প্রয়োজন সেই প্রয়োজন গুলোকে আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য নিজেরা উপযোগী হতে পারি ও অন্যদেরও উপযোগী করে তুলতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা যে আরো ৫০ বৎসরের ও বেশি এই 'গোপালী আশ্রম' দারুণভাবে এগিয়ে যাবে এবং মানবসেবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যে নয়, দেশে ও সারা পৃথিবীর মধ্যে মানবসেবা, প্রযুক্তি এবং ঈশ্বর চেতনা এই সমস্ত বিষয়কে একত্রিত করে কি করে একটি নতূন দিগন্তে পৌঁছানো যায় তার একটা হদিশ সবাইকে জানিয়ে দেবে। এই বলে সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান ও প্রণাম জানিয়ে উনি উনার মূল্যবান বক্তব্যের ইতি টানেন। এরপরে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট বক্তা পূজনীয় নির্গুনানন্দজী মহারাজ। তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিভিন্ন পদাধিকারীদেরকে বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন ভারতবর্ষের মানুষ তাদের ধর্মীয় আচরণের মধ্যে দানের একটা বিশেষ দিক ও চিন্তা ভাবনা আছে। গীতাতেও ভগবান দানের কথাই বলেছেন। মহাভারতেও দান কিভাবে করতে, কে যোগ্য- কে অযোগ্য। একটা কথা আমাদের প্রচলিত আছে 'সৎ পাত্রে দান ' করতে হবে। দানতো আমরা অনেকেই করি কিন্তু সেটা সঠিক পাত্রে যাচ্ছে কিনা সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। পৃথিবীতে সবাই দান করছেন।আমাদের মূল উদ্দেশ্য দেশ ও দশের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে যে অর্পণ করে তাকেই বলে দান। মুনি ঋষিরা বলেছেন সেটাই হবে ' মানব কল্যাণের' পথ। মানুষ কিভাবে সুখী হতে পারে তার দুঃখ মোচনিই হল সুখের পথ। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সনাতন ধর্মেও শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রভাব আনতে হবে। গোপালী আশ্রম একটি তপোবন আশ্রম। তাঁরা দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে সেবা, কর্মশালা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বলে মঞ্চে উপবিষ্ট সবাইকে প্রণাম ও সম্মান জানিয়ে বক্তব্য সমাপ্তি করেন। এরপরে বক্তব্য রাখেন মাননীয় শ্রী রমাপদ পাল মহাশয়। তিনিও মঞ্চের গুণী ব্যক্তিদের বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে তার সংক্ষিপ্ত ভাষণ শুরু করেন। তিনি বলেন আমাদের সৌভাগ্য যে আদ্যাশক্তি মহামায়ার কৃপায় আজ মাতৃ আরাধনার কাজ চলছে। এই সময় আমাদের 'বিশ্ব হিন্দু পরিষদে'ও ৬০ বছর পুর্তি হয়ে গিয়েছে। আবার গোপালী আশ্রমেরও ৫০ (পঞ্চাশ) বৎসর পূর্ণ হল। তিনি আরো বলেন আমরা সৌভাগ্যবান সারা পৃথিবী জুড়ে যে সংগঠন যার নাম RSS (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) গত ২ তারিখে সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী আরএসএস-এর ১০০ (একশত) বছর পূর্তি হয়ে গেল। ভারত বর্ষ ছাড়াও পৃথিবীর ৬০ টি দেশে যেখানে হিন্দুরা আছেন সেখানেও এই সেবা কাজ চলছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের কাজ ও লক্ষ্য হিন্দু সমাজের মধ্যে সংগঠন করে, হিন্দু সমাজকে সংগোঠিত করে ভারত বর্ষকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এই মুহূর্তে এক লক্ষ ২৯ হাজার জায়গাতে সেবা কাজ চলছে। যেরকম ভাবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কাজ চলছে। সবাইকে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে রমাপদ বাবু তাঁর মূল্যবান বক্তব্যের ইতি টানেন। এরপরে আশ্রমের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং শিক্ষামূলক, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা মূলক একটি নাটক পরিবেশিত করেন। লেখক তার উপসংহারের ইতি টেনে কিছু কথা বলছি :- বিশ্ব মহামানব স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ' টাকায় কিছু হয় না, বিদ্যায় নয়, নামেও নয়, যসেও নয়, ভালোবাসাতে সব হয়।ভালোবাসাতে বিশ্ব জয় করা যায় '। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর শহরের 'গোপালী আশ্রম' আজকে হাওড়া জেলার শরৎ সদনের প্রেক্ষাগৃহে এক ভালোবাসার আঙিনায়, ভালোবাসার টানে বিশিষ্ট গুণীজনদের উপস্থিতি এবং মানব কল্যাণ গুণোগ্রাহী দর্শকদের ভিড়ে সভাগৃহকে আলোকিত করেছিল। কর্মই হলো ধর্ম আবার ধর্মই হলো কর্ম। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন 'ধর্ম এমন একটি ভাব যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।' 'জীবনে এসেছো যখন একটা দাগ কেটে যাও ।' সত্যিই 'গোপালী মানব কল্যান আশ্রম ' গত ৫ই অক্টোবর শরৎ সদন প্রেক্ষাগৃহে একটি মনোনীত দাগ কেটে গেলেন। আমার লেখা একটি স্বরচিত কবিতা 'জীবন ' দিয়ে সমাপ্তি করছি। জীবন আসে জীবন থেকে- একথা জানে সবাই কিন্তু দেহ থেকে জীবন গেলে থাকে শুধু এক তাল রক্ত মাংস অন্তর্জলী যাত্রার অপেক্ষায়। পেটের জন্য জীবন নয়কো, জীবনের জন্য পেট। সুর,তাল,ছন্দ যার যেমন তর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জীবনও তাঁর তেমন তর। ভোগ নিয়ে জীবন যার, দুর্ভোগ নিয়ে মরন। আবার এমন জীবন করিবে গঠন মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।