বাংলাদেশে সরগরম পুজোর বাজার, কেনাকাটায় ভারত না যেতে পেরে আক্ষেপ অনেকের!

ঢাকা, জাকির হোসেন: ঘনিয়ে আসছে দূর্গাপুজো। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর, ধরনীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা৷ বুধবার (৯ অক্টোবর) মহাষষ্ঠী থেকে শুরু হয়ে আগামী রবিবার (১৩ অক্টোবর) বিজয়া দশমী অবধি চলবে শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আয়োজন৷ উৎসবের আনন্দে কেনাকাটার ভিড় লেগেছে বাংলাদেশে৷ ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুজোর কেনাকেটা মূলত মহাঅষ্টমীর মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। শারদীয় দূর্গাপুজো উপলক্ষে ভালো বিক্রি হওয়ায় রাজধানী ঢাকার শপিং সেন্টার, ফ্যাশন হাউজ ও অন্যান্য খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে বিক্রেতাদের মুখে হাসি ফুটছে। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই দোকানে দোকানে ভিড় বেড়ে জনপ্লাবনের চেহারা। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সৃষ্ট নাজুক ও অনাকাক্ষিত পরিস্থিতির কারণে পুজোয় বেচা-বিক্রি নিয়ে কিছুটা সংশয়ে ছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই আশঙ্কা এখন কেটে গেছে। রবিবার (৬ অক্টোবর) ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুজো উপলক্ষে জমজমাট কেনাবেচা চলছে। সেখানে আড়ং, দেশী দশ, রিচম্যান, ইনফিনিটি, অঞ্জন’স সহ বিভিন্ন পোশাকের শো-রুমগুলিতে প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। জুতোর দোকানগুলিতেও দেখা গেল একই চিত্র। বাটা, বে এম্পোরিয়াম, এপেক্স সহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের জুতোর শো-রুমে চলছে ধুন্ধুমার কেনাকাটা। খুচরা বিক্রেতারা বলেছেন, এবার দূর্গাপুজো উপলক্ষে বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। সময় মতো ভিসা না পাওয়ায় অনেকে কেনাকাটা করতে পড়শি দেশ ভারতের কলকাতায় যেতে পারেননি। এ কারণে তারা এখন দেশেই কেনাকাটা করছেন। আর এতে দেশের বাজারে বেচাবিক্রি বেশ ভালো হচ্ছে। পুজোর আগে কলকাতায় শপিং করার ইচ্ছা ছিল মুগদা এলাকার বাসিন্দা স্বর্ণালী বিশ্বাসের৷ তিনি আক্ষেপ করে বললেন, 'হঠাৎ করে ভারতীয় ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগছে৷ এবার অনেক ইচ্ছে ছিল পুজোর কেনাকাটা কলকাতা থেকে করে আসবো৷ হলো না কী আর করার!' দূর্গাপুজোকে সামনে রেখে বেশিরভাগ ফ্যাশন ব্র্যান্ড, পোশাকের খুচরা বিক্রেতা ও ইলেক্ট্রনিক্স ব্র্যান্ডগুলো নতুন পণ্য নিয়ে আসার পাশাপাশি মূল্য ছাড় সহ নানান অফার দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসেব মতে, বাংলাদেশে উৎসব উপলক্ষে মোট বিক্রির প্রায় ৭০ শতাংশ হয় দুই ঈদে এবং বাকিটা হয় পহেলা বৈশাখ ও দূর্গাপুজোয়। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, পুজোর সময় শাড়ি ও সালোয়ার কামিজের বেশি চাহিদা থাকে। ক্রেতারা কাতান, সিল্ক ও নকশাদার শাড়ির প্রতি বেশি আগ্রহী। জামদানির চাহিদাও অনেক বেশি। নারীদের পোশাকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে সালোয়ার কামিজ, জামদানি শাড়ি, বলাকা সিল্ক, কাতান শাড়ি, লেহেঙ্গা ও তাঁতের শাড়ি। ছেলেদের জন্য রয়েছে বাহারি ডিজাইনের ধুতি, শর্ট পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট। স্বল্প আয়ের মানুষ কেনাকাটা করছেন নিউমার্কেট এলাকা, গুলিস্তান, বঙ্গবাজারে অবস্থিত মার্কেট ও আশপাশের ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানগুলি থেকে৷ পুজো উপলক্ষে দর্জির দোকানগুলিতেও ব্যাপক ক্রেতা সমাগম হচ্ছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হৃদিতা মল্লিক তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে এসেছেন পুজোর কেনাকাটা করতে। তিনি বললেন, গত দুই সপ্তাহে পরিবারের জন্য কেনাকাটায় ৪৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। তিনি তার বাবা, স্বামী ও ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কেনাকাটা সেরেছেন। এ ছাড়াও, তার মা ও অন্য নিকটাত্মীয়দের জন্য শাড়ি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নানা পণ্যসামগ্রী কেনা হয়েছে। বসুন্ধরা শপিং মল ছাড়াও ঢাকা নিউ মাকের্ট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, ইস্টার্ন মল্লিকা, মোতালেব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা, যমুনা ফিউচার পার্ক, ধানমন্ডি ও পুরান ঢাকার বিপণিবিতানগুলি ঘুরে দেখা যায়, সবারই বিক্রি বেশ বেড়েছে। এমনকি পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট দোকানেও ক্রেতাদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিরত গোপাল সরকারের সাথে দেখা হয় ধানমন্ডির হকার্স মার্কেটে। তিনি জানালেন, ‘মা, স্ত্রী ও দুই বোনের জন্য আটটি শাড়ি কিনেছি।’ নিজের জন্য কিনেছেন শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট ও জুতো৷ তিনি বললেন, 'এই পুজো আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। উপহার দেওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। এবার মার্কেটে অনেক বেশি ভিড়। মনে হচ্ছে অন্যবারের তুলনায় বেচা-বিক্রি বেশি হচ্ছে৷' গাউছিয়া মার্কেটের ফাহাদ ফ্যাশন হাউজের কর্ণধার ফরহাদ হোসেন জানান, এই বছর পুজোয় বেচাকেনা ভালো। দূর্গাপুজো শুরুর পর কমপক্ষে আরও তিন দিন বিক্রি অব্যাহত থাকে৷ দূর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানগুলিতে ভিড় জমেছে। কেনাকাটার অন্যতম অনুষঙ্গ প্রসাধনী। নারীরা প্রসাধনীর দোকানে এসে তাদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী কিনছেন। পাশাপাশি কিনছেন হাত, কান, নাক ও গলার ইমিটেশন অলঙ্কার। বিচিত্রা কসমেটিকসের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম জানালেন, 'কসমেটিকসের কেনাকাটা বছরজুড়েই চলে। এখনও চলছে। তবে পুজো ঘিরে আলাদা চাহিদা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।' পুরান ঢাকার গ্রেট ওয়াল মার্কেটে সরেজমিনে দেখা যায়, ক্রেতারা পুজো উপলক্ষে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনছেন। শিশু ও মেয়েদের পোশাকের দোকানগুলোতে অন্য দোকানগুলোর তুলনায় একটু বেশি ভিড় লক্ষ করা গেছে। পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, শাড়ি, থ্রি পিস, জুতা, গহনা ও প্রসাধনী সহ বাচ্চাদের পোশাকেরও চাহিদা রয়েছে। শপিংয়ে আসা জনসন রোডের বাসিন্দা শমরিতা শ্রেয়সী জানালেন, 'কসমেটিকস সবসময়ই লাগে। তবে বিশেষ ইভেন্টে বিশেষ কিছু কসমেটিকসের প্রয়োজন হয়। এখানে কসমেটিকস কিনতে এসেছি৷ ইমিটেশনের গহনাও কিনব।' এদিকে, পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুজোর প্রস্তুতি ঘিরে প্রতি বছরের মতো পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই শাঁখারীবাজারের দোকানগুলি ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। শাঁখা, শঙ্খ, প্রতিমার কাপড়, ঘণ্টা, ঘট, প্রদীপ, আগরবাতি, ঠাকুরের মালা, কদম মালা, জবের মালা, মুকুট থেকে শুরু করে শাড়ি, ধুতি, পাঞ্জাবি সহ অলঙ্কারের দোকানগুলোয় চলে কেনাকাটার ধুম। মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়ের কর্ণধার সৌমিত্র দাস জানালেন, শাঁখা, আলতা, সিঁদুর, প্রদীপসহ অন্যান্য উপকরণও বিক্রি হচ্ছে। আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শারদীয় দূর্গাপুজো শুরু হবে। ১৩ অক্টোবর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই মহোৎসব। এবার দেবী দূর্গার মর্তে আগমন দোলায় আর স্বর্গে গমন ঘোটকে।

উল্লেখ্য, চলতি বছর বাংলাদেশে মোট ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে শারদীয় দূর্গাপুজো হবে যার মধ্যে রাজধানী ঢাকাতে ২৫৭টি মণ্ডপে পুজো অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানাচ্ছে, আগামী ৯ সেপেটম্বর বুধবার বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব৷ এদিকে, দুর্গাপুজোয় বিজয়া দশমীর ছুটি সহ রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিজীবীদের টানা তিনদিন ছুটি উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিজয়া দশমী হবে ১৩ অক্টোবর। সেদিন রবিবার এবং সরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। এর আগের দু'দিন, অর্থাৎ শুক্রবার এবং শনিবারও ছুটি থাকবে। এর ফলে টানা ৩ দিন ছুটি কাটাতে পারবেন সরকারি কর্মীরা। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস এবং সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় এই ছুটি পাওয়া যাবে। তবে যে সব অফিসের সময়সূচি এবং ছুটি তাদের নিজস্ব আইন-কানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় বা যে সমস্ত অফিস, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের চাকরি সরকারে পক্ষে অত্যাবশ্যক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অফিস, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইনকানুন অনুযায়ী জনস্বার্থ বিবেচনা করে এই ছুটি ঘোষণা করবে৷ বাংলাদেশের সরকারি নির্দেশ এবং নিয়ম অনুসারে, একজন কর্মচারীকে তাঁর নিজ ধর্ম অনুযায়ী বছরে অনধিক মোট তিন দিন ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে৷ প্রত্যেক কর্মচারীকে বছরের শুরুতেই নিজ ধর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত তিনদিনের ঐচ্ছিক ছুটির জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নিতে হয়। আধিকারিকরা এই আবেদন অনুমোদন করলে তাঁরা সেটা উপভোগ করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে দূর্গাপুজো উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তিনদিন ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার সুযোগ পাবেন।