সূচিতেই ফাঁদ! প্রতিপক্ষ নয়, ২০২৬ বিশ্বকাপে বড় শত্রু আবহাওয়া, উচ্চতা আর যাত্রাপথ!
নিজস্ব সংবাদদাতা : শুক্রবার গ্রুপবিন্যাস প্রকাশের পর অনেক বড় দলই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ পেয়ে কোচদের মুখে ছিল হাসি। কিন্তু শনিবার পূর্ণাঙ্গ সূচি প্রকাশ হতেই সেই হাসিতে পড়েছে বড়সড় চিড়। এখন পরিষ্কার— ২০২৬ বিশ্বকাপের লড়াই শুধু মাঠের ভিতরে নয়, মাঠের বাইরের যুদ্ধও হবে সমান কঠিন। দীর্ঘ যাত্রাপথ, আমেরিকার প্রখর গরম আর মেক্সিকোর ভয়ঙ্কর উচ্চতা— সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তায় বিশ্ব ফুটবলের তাবড় শক্তিগুলো। স্পেনের পরিস্থিতিই ধরুন। গ্রুপবিন্যাসের দিন কোচ লুই দে লা ফুয়েন্তে ছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসী। উরুগুয়ে ছাড়া গ্রুপে বড় কোনও বাধা নেই— এমনটাই ধরা হচ্ছিল। কিন্তু সূচি প্রকাশের পর বাস্তবতা বদলে গিয়েছে। স্পেন তাদের প্রথম দু’টি ম্যাচ খেলবে আমেরিকার আটালান্টায়। তাপমাত্রা থাকবে ৩৩ থেকে ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে, সঙ্গে বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। যদিও স্টেডিয়ামের ছাদ ঢাকার সুবিধা থাকায় কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।
কিন্তু আসল ধাক্কা অপেক্ষা করছে তার পরেই। আটালান্টা থেকে প্রায় ২৮০০ কিলোমিটার দূরে মেক্সিকোর গুয়াদালাহারায় উড়ে যেতে হবে স্পেনকে। এই শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আলাদা টাইম জোন, পাতলা বাতাস, উপক্রান্তীয় আবহাওয়া— সব মিলিয়ে চরম চ্যালেঞ্জ। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলার পর যাতায়াত ও বিশ্রাম মিলিয়ে অনুশীলনের জন্য স্পেন পাবে মাত্র তিন দিন। সেই অবস্থাতেই মার্সেলো বিয়েলসার শক্তিশালী উরুগুয়ের বিরুদ্ধে গ্রুপের সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে তাদের। ফুয়েন্তে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা ম্যাচের মাঝের দীর্ঘ যাত্রাপথ। তিন-চার দিনের মধ্যে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে।” বার্তা পরিষ্কার— সহজ গ্রুপ পেলেই ট্রফির পথ মসৃণ হবে না। সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে সেই সব দল, যাদের বড় অংশের ম্যাচ মেক্সিকোয়। সেখানে রয়েছে তিনটি ভেন্যু— তিনটির চরিত্রই আলাদা। রাজধানী মেক্সিকো সিটির ঐতিহাসিক অ্যাজটেকা স্টেডিয়াম সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার জায়গা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ মিটার উঁচু এই মাঠেই মারাদোনা করেছিলেন সেই কিংবদন্তি ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল। গত পাঁচ দশকে বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জন পর্বে এই মাঠে মাত্র দু’বার হেরেছে মেক্সিকো। পাতলা বাতাসে বল অদ্ভুত গতিপথ নেয়। প্রাক্তন মার্কিন গোলকিপার টিম হাওয়ার্ড একে তুলনা করেছিলেন “উড়ন্ত সসার”-এর সঙ্গে। তাঁর কথায়, “এই মাঠে গোলকিপিং করা মানেই দুঃস্বপ্ন।” মেক্সিকোর আর এক ভেন্যু মন্টেরে। উচ্চতা তুলনায় কম হলেও এখানে গরম ভয়ঙ্কর। আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত লাগোয়া এই শহরে বৃষ্টির সম্ভাবনা কম, কিন্তু তাপমাত্রা ছুঁতে পারে ৪০ ডিগ্রি। তাপপ্রবাহ হলে ম্যাচ খেলা কার্যত আগুনে হাঁটার সমান। এর তুলনায় সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা কানাডা। ভ্যাঙ্কুভার ও টরন্টোর স্টেডিয়ামগুলি কম উচ্চতায়, আবহাওয়াও অনেকটাই সহনীয়। আমেরিকার ১২টি মাঠের মধ্যে ১১টিতেই ছাদ ঢাকা, ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে দুপুরের ম্যাচ হলে ইউরোপীয় দলগুলোর সমস্যার শেষ থাকবে না— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংল্যান্ড কোচ থমাস টুখেল আগেভাগেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, পরিবর্ত খেলোয়াড়দের ডাগআউটে বসিয়ে রাখা হবে না। তাঁদের স্টেডিয়ামের ভিতরে ঠান্ডা জায়গায় রাখা হবে, যাতে অতিরিক্ত ঘেমে আগেই ক্লান্ত না হয়ে পড়েন। যদিও সূচি অনুযায়ী ইংল্যান্ডের ভাগ্য তুলনায় ভালো— তারা খেলবে বস্টন ও নিউ ইয়র্কের মতো আরামপ্রদ শহরে।
সব মিলিয়ে এখনই স্পষ্ট— ২০২৬ বিশ্বকাপে শুধু প্রতিপক্ষই নয়, আবহাওয়া, উচ্চতা আর যাতায়াতও হয়ে উঠবে বড় শত্রু। ট্রফি জিততে গেলে মাঠের লড়াইয়ের পাশাপাশি এই অদৃশ্য বাধাকেও হারাতে হবে বিশ্ব ফুটবলের শক্তিগুলোকে। ৪৮টি দল, ১২টি গ্রুপ, ১০৪টি ম্যাচ— ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বকাপে এ বার যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত নক-আউট রাউন্ড। ফলে ট্রফি জিততে হলে আগের চেয়ে অন্তত একটি ম্যাচ বেশি খেলতেই হবে সব বড় দলকে। অর্থাৎ সামান্য ভুল মানেই বিদায়ের ঘণ্টা।