"মা" - শ্রীমন্তী ভাণ্ডারী
মা মানে খুব ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ঘুম জড়ানো আলস্য ভরা চোখে দেখতে পাওয়া রান্নাঘর থেকে ছিটকে আসা এক ফালি বাল্ব - এর মৃদু আলো। মায়ের ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল, ব্যস্ত অবয়ব। দুটো হাত ভীষণ ব্যস্ত রান্নাঘরে রান্না করতে। দুপুরের খাবার ও আমাদের বিদ্যালয়ের জন্য টিফিন বানাতে। তারপর নিজে প্রস্তুত হয়ে বেরোবে তাঁর কাজের জায়গায়। সরকারী বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষিকা পদে চাকুরীর জন্য। মা মানে সকালবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে শোনা বেতারে চালানো গান।
" তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।"
সকালে ঘুম ভাঙার পর সেই গান প্রথম শুনে ভীষণ, ভীষণ মন ভাল হয়ে যেত। দিনের প্রথম শুরুটা খুব ভালভাবে, সুন্দরভাবে শুরু হত। যে ভাললাগার রেশ সারাদিন মনের মধ্যে ছড়িয়ে থাকত আলোর মতো, ফুলের মধুর সুগন্ধের মতো। মা মানে ভীষণ ভাল, ভাল রান্না করা খাবার। বাংলার পুরাতন, অবলুপ্ত হারিয়ে যাওয়া খাবারের সুলুক সন্ধান। নিমকি, আচার, বড়ি থেকে শুরু করে পোলাও, কোরমা, কালিয়া , পায়েস, চাটনি , কি নেই সেই তালিকায়!
রান্নার প্রতি আমার নিগূঢ় ভালবাসা আসলে তাঁর কাছ থেকেই হয়ত এসেছে। মা মানে ঘর ও বাইরের চমৎকার ভারসাম্য, সামঞ্জস্য রক্ষা করা।
রাত জেগে বিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা দেখা, কখনো বা রাত জেগে আমাদের পড়ার নোটস তৈরী করে দেওয়া আবার কখনো বা আমাদের পড়ার সময় কাছে বসে থাকার জন্য সোয়েটার বোনা বা সেলাই মেশিনে জামা, কাপড় সেলাই করা বা নতুন কিছু তৈরী করা। সারাদিনের তাঁর অক্লান্ত কাজ, অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে কোথাও , কোনোদিন একবিন্দু গরমিল দেখিনি। কোথাও এতটুকু অগোছালো ব্যাপার চোখে পড়েনি। আমার বাবাও পেশায় শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু কর্মসূত্রে তাঁকে দূরে থাকতে হত। সপ্তাহান্তে তিনি বাড়ি ফিরতেন। সারা সপ্তাহ মা ,আমাদের দুই বোনকে নিয়ে একাই সবকিছু সামলাতেন।
ঘর সংসার,বাগান কি চমৎকার সাজানো গোছানো, পরিপাটি থাকত তাঁর লক্ষ্মী হাতের গুণে।
ছোটবেলা থেকে সেই শিক্ষা তাঁর কাছেই পাওয়া। বাইরের কাজের জগৎ এর সাথে ঘরটাকেও ভালবাসার নিপুণ ভারসাম্যের দাঁড়িপাল্লায় সমান ওজনে বসিয়ে রাখা। মা মানে শান্ত, স্নিগ্ধ, অন্তর্মুখী, মধুর ব্যক্তিত্বের এক নারী। যিনি দাঁতে দাঁত চেপে সব কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করেও মুখে প্রকাশ করেনা। মনের জোরে , সাহসের সঙ্গে সব প্রতিকূলতার সাথে শক্ত হাতে লড়াই করা।
বড়াই না করে লড়াই করা।
মা মানে খুব ঘরোয়া, সাজগোজ না করা সাদামাটা চেহারা। ঘরে আটপৌরে করে পরা তাঁতের বা ছাপা শাড়ি।চিরন্তন ঘরোয়া , বাঙ্গালী বধূর শাখা, পলা, সিঁদুর।
বৃস্পতিবার লক্ষ্মী পূজা, পাঁচালী পড়া, সন্ধ্যে হলে দুই পায়ের পাতা আলতা দিয়ে রাঙানো। পরনিন্দা, পরচর্চা, সমালোচনায় মুখর না হয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়া। অথচ দরকারে পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের প্রতি তাঁর সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে দেওয়া। সুমিষ্ট ব্যবহারে সবার মন জয় করা। মায়া, মমতা , ভালবাসার স্নিগ্ধ, সবুজ ছায়া হওয়া। এই সবকিছু নিয়েই আমার মা, আমার প্রিয় মা। আর সবশেষে যে কথাটা না বললে, আমার তাঁর সম্পর্কে পুরো বলাটাই অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে, সেটা হল, তাঁর সাহিত্য, গানের প্রতি তীব্র অনুরাগ আর লেখার প্রতি তীব্র ভালবাসা, টান। যখনই মা অবসর পেত কাজের ফাঁকে, তখনই দেখতাম বসে পড়ত তাঁর লেখার প্রিয় খাতা বা ডায়েরী নিয়ে। আর তার নিজস্ব অনুভব, উপলব্ধি, কল্পনাতে ভরিয়ে তুলত ডায়েরীর সাদা পাতা। আর প্রকৃতির কোনো রূপ দেখে তার বালিকা সুলভ উচ্ছলতা , চপলতা মন ছুঁয়ে যেত। সেই কবে কোনো ছোটবেলায় তার খালি গলায় গাওয়া গান , রবি ঠাকুরের "আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা" গানটি প্রথম শুনে মনের মধ্যে যেন আলোর রোশনাই খেলে গিয়েছিল। সত্যিই তো আলোর আছে সেই আশ্চর্য ক্ষমতা তার প্রভাবে মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়। আজ এই মধ্যবয়সে আশ্চর্য হয়ে ভাবি, আমার যে এই গান, কবিতা , গল্প, প্রকৃতি, লেখার প্রতি টান তাঁর কাছ থেকেই জন্মেছে। মায়ের সেই লেখার প্রতি আবেগ, ভালবাসা, টান আমি আমার লেখার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করব। মায়ের মাতৃত্বের সত্তা ছাড়া আর যে দুটি সত্তা আছে, তার শিক্ষিকা সত্তা আর লেখিকা সত্তা তা আমরা দুই বোনে বাঁচিয়ে রাখব। আমার দিদি বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁর শিক্ষিকা সত্তা, আর আমি বাঁচিয়ে রাখব তাঁর লেখিকা সত্তা আমার লেখার মাধ্যমে।
আজ মাতৃ দিবসের শুভ দিনে আমার মায়ের লেখা একটি কবিতা দিয়ে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি।