বাংলাদেশে এবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানালেন সাবেক সেনাপ্রধান সহ সশস্ত্র বাহিনীর বহু কর্তা!

ঢাকা, জাকির হোসেন : নিজেদের ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইলে ‘লাল রঙের’ ছবি দিচ্ছেন কোটা আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া শিক্ষার্থী ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। হত্যা ও নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে ও শাসকদল আওয়ামী লীগের প্রতি প্রতিবাদস্বরূপ দেশ-বিদেশের লাখ লাখ বাংলাদেশি নিজেদের প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে লাল রঙ সেঁটে দিয়েছেন। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষার্থী, নামিদামি অনেক ব্যক্তি, এমনকি বিদেশিরাও এমনটা করছেন। এবার শিক্ষার্থীদের সমর্থন জানিয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া৷ কাভার ফটো বদল করেও তিনি দিয়েছেন লাল রঙের ছবি৷ তিনি ছাড়াও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাক ইকবালও ৩১ জুলাই বুধবার তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার লাল করেছেন৷ এছাড়াও বহু অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর কর্তারা শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন৷ উল্লেখ্য, এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ সহ দেশের প্রায় সব স্কুল-কলেজের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ুয়ারাও সংহতি জানিয়ে অংশ নিলে তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলিবর্ষণ করে শাসকদলের মদতপুষ্ট পুলিশ, র‍্যাব ও সন্ত্রাসীরা৷ দেশজুড়ে এদের তাণ্ডবে বাংলাদেশ রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, প্রাণ হারায় হাজার হাজার পড়ুয়া ও সাধারণ মানুষ৷ পড়ুয়াদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা ও গুলিবর্ষণ করা ওই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে প্রমাণিত হয় ওরা শাসকদলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী৷

৩০ জুলাই মঙ্গলবার রাতে প্রোফাইল পিকচার ও কাভার ফটো পরিবর্তন করেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া৷ এই সংবাদ লেখা অবধি তার প্রোফাইল পিকচারে লাইক ৪৫ হাজার ও কাভার ফটোতে লাইক ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে৷ হাজারো মানুষ তা শেয়ার ও মন্তব্য করেছেন। প্রায় সব ব্যবহারকারী তার এমন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। অনেকে শেয়ার করে লিখেছেন: ‘ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। সাবেক আর্মি চিফ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আর কী লাগে!’ কর্মজীবনে ইকবাল করিম ১৯৭৬ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২০১০ সালের মে মাসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন। ২০১২ সালের ২৫ জুন তাঁকে সেনাপ্রধান করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ জুন অবসরে যান। ১৬তম সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি জেনারেল আবদুল মুবীনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালের ২ জুন কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন ইকবাল করিম। কুমিল্লা জিলা স্কুল এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতায় দেশে-বিদেশে সেনাবাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন তিনি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান যাতে আরো মর্যাদাপূর্ণ হয়, সে জন্য গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন পদক্ষেপ। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে সেনা সদস্যদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, রেশন, আবাসন, মেসে খাবারের মানোন্নয়ন এবং সিএমএইচে আরো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে।

ইকবাল করিম ভূঁইয়া দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দেশ-বিদেশে বেশ কটি প্রফেশনাল কোর্সে অংশ নেন। তিনি মালয়েশিয়ায় কম্পানি কমান্ডার কোর্স, যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড ডিফেন্স ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল স্টাডিজে 'কোর্স অন পিস কিপিং ফর ডিসিশন মেকার্স' সম্পন্ন করেন। ইকবাল করিম ভূঁইয়া মিরপুরে ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ড অ্যান্ড জেনারেল স্টাফ কলেজের গ্র্যাজুয়েট।

এছাড়া তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জেএফকে স্কুল অব গভর্নমেন্টে অনুষ্ঠিত ইনিশিয়েটিভ ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট এবং সিয়েরালিয়নের ফ্রিটাউনে লজিস্টিক সাপোর্ট ইস্যুজ-বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন।

মেসে থাকা সৈনিক ও সিএমএইচে ভর্তি রোগীদের খাবারের মান উন্নয়নে কাজ করেন তিনি। সামরিক হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ, বহির্বিভাগ, ওয়ার্ড ও শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবল সংকট নিরসন, সব স্তরের সেনাসদস্যের পারিবারিক পেনশনের হার বাড়ানো- এসব ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অনেক। এছাড়া সেনাবাহিনীর এভিয়েশন ইউনিটের বৈমানিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, কমান্ডো-প্যারাকমান্ডো সদস্যদের উড্ডয়ন ঝুঁকি বিমার আওতায় আনা, নতুন বেতন-স্কেল প্রণয়নে তার ভূমিকার প্রশংসা রয়েছে অনেক।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে হাজার হাজার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ৩০ জুন মঙ্গলবার সারাদেশে শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর রাতে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির পক্ষে রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ৩০ জুন মঙ্গলবার মুখ ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলার কর্মসূচি ঘোষণা করেন কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক। এই কর্মসূচি ঘোষণার পর ওই রাত থেকেই ফেসবুকের প্রোফাইলে লাল রঙের ফ্রেম সাঁটাতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা তাদের ফেসবুক প্রোফাইলে লাল ফ্রেম সাঁটিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, কামরুল হাসান, সামিনা লুৎফা, রুশাদ ফরিদী, কাজলী সেহরীন ইসলাম, সাইফুল আলম চৌধুরী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জামিল খান প্রমুখের ফেসবুক প্রোফাইলে লাল রঙের ফ্রেম দেখা গেছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ লাল ফাগুনের লাল, বিপ্লবের লাল। কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক ও লেখক জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’-এর উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে ক্যাপশন দিয়েছেন: ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো।’ অনেক শিক্ষার্থী আবার ছন্দের তালে লিখেছেন: ‘যৌবন তুমি আগুন হও, লাল পলাশের ফাগুন হও! আর আসছে ফাগুন অনেক দেরি, এক্ষুনি দ্বিগুণ হও।’ শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরে পুরো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশেষ করে তারকাদের প্রোফাইলও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে লালে লাল হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাক ইকবাল আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের সাথে সংহতি জানিয়ে তার প্রোফাইল পিকচারে লাল রং পোস্ট করেন৷ চিত্র: সংগৃহীত৷