বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ সরে গেছে, সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের নীরবতা দাসসুলভ আচরণ আখ্যা বিএনপি মহাসচিবের, উচ্চারণ করলেন ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপ্লবের কথাও!

ঢাকা জাকির হোসেন: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপের আশপাশে গোলাগুলি এবং মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ থেমে গেছে। এতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা গত ১৪ জুন শুক্রবার ভোররাত থেকে ১৫ জুন শনিবার দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে আর কোনো শব্দ শুনতে পাননি। অন্যদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থানরত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজটিও আর শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে দেখা যাচ্ছে না। ওই এলাকা সংলগ্ন সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, ‘গত বৃহস্পতিবার সারা রাত বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল পুরো টেকনাফ। শান্তিতে লোকজন ঘুমাতে পারেনি। তবে শুক্রবার ভোর রাত থেকে শনিবার বেলা একটা পর্যন্ত আর কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। নতুন করে যাতে সীমান্ত পেরিয়ে কোনো লোক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, ‘সীমান্তে শুক্রবার ভোর রাত থেকে আর গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে দ্বীপে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। কখন থেকে তারা আগের নৌপথে (টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন) যাতায়াত করতে পারবে, সেটি নিয়ে দ্বীপের সাড়ে ১০ হাজার মানুষ চিন্তিত রয়েছেন। কারণ, বর্তমানে যে পথে চলাচল করা হচ্ছে তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’

সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথের শাহ পরীর দ্বীপ বদরমোকাম এলাকায় দুই দিন ধরে অবস্থান করা মিয়ানমারের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজটি সেখান থেকে সরে গেছে। যুদ্ধজাহাজটি পরে মিয়ানমারের জলসীমানায় অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংদিয়া অংশে অবস্থান করছিল। গতকাল সন্ধ্যার পর সে স্থান থেকেও সরে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী৷ ইউএনও বলেন, 'শুক্রবার ভোর থেকে শনিবার বেলা একটা পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে আর কোনো গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি এসব তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে বড় জাহাজটি অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি একের পর এক মিয়ানমার থেকে সার্ভিস ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ জন্য আপাতত এ নৌপথ দিয়ে সেন্টমার্টিনে যাতায়াত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সার্ভিস ট্রলারগুলো বিকল্প রুটে সাগর উপকূলীয় পথেই সেন্টমার্টিন যাতায়াত করবে।'
 
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন বলেন, পরিস্থিতি আগের তুলনায় শান্ত। তবে যদি সেখানে বড় ধরনের সংঘর্ষ শুরু হয়, আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে৷

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, টানা সাড়ে তিন মাস মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের মংডু টাউনশিপের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দুটি শহরসহ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১৪টি সীমান্তচৌকি, রাচিডং-বুচিডং টাউনশিপের বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এখন মংডু দখলের জন্য লড়ছে তারা।

উল্লেখ্য, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ৷ এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মিয়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত৷ প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে৷ বাংলাদেশের ও বিশ্বের সমুদ্রপ্রেমীদের কাছে এটি ব্যাপক পরিচিত একটি নাম। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে বাংলাদেশের নয়ানাভিরাম এই দ্বীপ থেকে দেখা যাচ্ছিলো মিয়ানমারের তিনটি যুদ্ধজাহাজ। গত কয়েকদিন ধরে একই জায়গায় নোঙর করে ছিল জাহাজগুলো। এর ফলে দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

১৪ জুন শুক্রবার সকালেও সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে স্থানীয় বাসিন্দারা গিয়ে দেখতে পায় মিয়ানমারের তিনটি যুদ্ধজাহাজ নোঙর করে আছে। উল্লেখ্য, এর আগেও মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিলো, সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটিয়েছে৷ তখন বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের কাছে শুধু প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েই সীমাবদ্ধ ছিলো৷ এবারের ঘটনায়ও সরকার এখন অবধি মিয়ানমার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ জানাতে পেরেছে মাত্র৷ কঠোর কোনো ব্যবস্থা বা আন্তর্জাতিকভাবে কোনো পদক্ষেপের দিকেও এগোতে দেখা যায়নি বাংলাদেশ সরকারকে৷

এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সাম্প্রতিক এ ঘটনার উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'মিয়ানমারের মতো একটা দেশকেও কিছু বলা যাবে না? এটা যে কতটা নতজানু, দাসসুলভ মনোভাব হতে পারে! সীমান্তে মানুষ মারছে, পানি দিচ্ছে না, অথচ সরকার একটা কথা বলে না।'

১৫ জুন শনিবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদপত্রের কালো দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব এসব কথা বলেন। তিনি একজন অর্থনীতির শিক্ষকও৷ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ এ সভার আয়োজন করে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, 'চীন বিশ্বে একনায়কতন্ত্র চলছে—এমন দেশের দিকে ঝুঁকছে। সারা বিশ্বেই একনায়কতন্ত্র বাড়ছে।'

অর্থনীতির এই শিক্ষক আরও বলেন, 'এখন প্রতিদিনই পুরো জাতির জন্যই কালো দিবস। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে এসেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ শুরু করেছে। সচেতনভাবে পরনির্ভরশীল দেশে পরিণত করছে।' সাংবাদিক যাঁরা সাহস করে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফখরুল বলেন, 'বেনজীর, আজিজ, আনারের ঘটনা সাংবাদিকেরাই তুলে এনেছেন।'

বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, 'সেনাপ্রধান জালিয়াতি করবেন, পুলিশপ্রধান ডাকাতি করে দেশে সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন, কল্পনা করা যায়?'

প্রসঙ্গত, বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান তথা আইজিপি, আজিজ আহমেদ বাংলাদেশের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান এবং আনার (আনোয়ারুল আজিম আনার) ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রাক্তন এমপি যাকে কলকাতায় কিছুদিন আগেই খুন করা হয়৷ বেনজীর ও আজিজ ব্যাপক দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত৷ আনারের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিস্তর অভিযোগ ছিল৷

সংবাদের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু বাণী প্রচার করা হয়, তিনি তা শুনছিলেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘উনি বলছিলেন, যারা আজকে সম্পদ লুণ্ঠন করে পাচার করে নিয়ে যায়, তাদের এ দেশের মাটিতে জায়গা নেই।’ তিনি বলেন, ‘যারা এখন ক্ষমতায় আছে, তারা কি একবারও এ কথা শুনছে?’

মির্জা ফখরুল বলেন,  ‘ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বিপ্লব করেছেন। আমাদেরও এটা সম্ভব। বলছি না যে এখান থেকেই করতে হবে। বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা করুক। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অমুক–তমুক আইন, গুম করে দেওয়ার বিষয় আছে।’

বিএনপির এই প্রবীণ নেতা বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে বাম–ডান সবাইকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি। সাংবাদিকরাও যদি এক প্ল্যাটফর্মে আসেন, তাহলে দেশে গণতন্ত্র ফিরবে।’

ধারণাপত্র পাঠ করেন বিএফইউজের একাংশের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন বলেন, 'আগে সাংবাদিকেরা কিছু বললে মান্য করা হতো, সম্মান ছিল অনেক। এখন সেই সম্মান হারিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে এক থাকতে হবে।'

বিএফইউজের সভাপতি রহুল আমিন গাজী বলেন, 'আগে সবাই এই দিন কালো দিবস পালন করতেন। এখন অনেকে তা সাদা দিবস বলতে চান। একদলীয় সংসদ। ১৯৭৫ সালে যে অবস্থা ছিল, এখনো সেই অবস্থা। এখন প্রতিদিনই ১৬ জুন চলছে। ন্যায়বিচার, স্বাধীন সাংবাদিকতা, গণতন্ত্র এখন স্বপ্নের মতো।' সভায় আরও বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, সৈয়দ আবদাল আহমদ, সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ।