নেপালে তথাকথিত জেন জেড আন্দোলন এক নাটকীয় মোড়!

নিজস্ব সংবাদদাতা: জেন জ়ি অথবা জেন জেড বলতে যে প্রজন্মকে বুঝানো হচ্ছে তাদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। অশান্ত নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দেশটির সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে বেছে নিয়েছে জেন জি। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্দোলনকারী তরুণরা কাঠমান্ডুতে এক ভার্চুয়াল সভা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশটির বিভিন্ন জেলা থেকে আন্দোলনকারী নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা এই আলোচনা সভায় যোগ দেন। সেখান থেকেই তারা কার্কিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে বেছে নেন। গত মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, পুলিশ গুলিতে প্রায় ২০ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার পর প্রবল চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ও তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

আন্দোলনের সূত্রপাত : নেপালের তরুণ প্রজন্ম, যাদের জেন জেড নামে অভিহিত করা হচ্ছে, মূলত দুটি ইস্যুতে রাস্তায় নামে—
১. মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা।
২. রাজনৈতিক মহলের অদম্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

যুবকদের দাবি ছিল, এই নিষেধাজ্ঞা একদিকে তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের তথ্য আড়াল করার কৌশল। ফলে ক্ষোভ দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন, যানবাহন ও সম্পত্তি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই ভাষ্যের আড়ালে যেটা অন্তরালে ক্লে যাচ্ছে তা হল, ২০২৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর নেপালের সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছিল যে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দেশে কার্যক্রম চালাতে হলে আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই আদেশ কার্যকর করতে সরকার ২৮শে আগস্ট একটি জনসাধারণের বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সাত দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা রেজিস্ট্রেশন করেনি, তাদের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে সরকার সেই প্ল্যাটফর্মগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) জেন জি বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবিগুলো স্পষ্ট করতে একটি ভার্চুয়াল সভা করেন। তাদের মূল দাবিগুলো হলো:

১)হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা: ২০০৮ সালের আগে নেপাল ছিল হিন্দু রাষ্ট্র। বিক্ষোভকারীদের একাংশ এই অবস্থানে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছে, যদিও এটি মূলধারার দাবি নয়।
২)কে পি শর্মা ওলির গ্রেপ্তার: দুর্নীতি ও সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগে ওলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি।
৩)প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ: কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
৪)দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান: রাজনীতিবিদদের সম্পদের স্বচ্ছ তদন্ত এবং তরুণদের জন্য শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ।
৫)বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৬)সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার: কার্কির নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনের প্রস্তাব।

জেন জেড আন্দোলনে কারা লাভবান? যদিও আন্দোলনটি আপাত দৃষ্টিতে 'অরাজনৈতিক', বাস্তবে দুই বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঘিরেই তরুণদের সমর্থন ঘনীভূত হয়েছে। স্থানীয় এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে যে, বুধবার বিকেলে কয়েক হাজার জেন-জি আন্দোলনকারী ভার্চুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সুশীলা কার্কিরর নাম ঘোষণা করে। নেপালের বিভিন্ন জেলা থেকে পাঁচ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী একটি ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। কার্কি তরুণদের ডাকে সাড়াও দিয়েছেন।স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, জেন জি আন্দোলনের নেতারা তাদের এজেন্ডা তৈরির জন্য একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করে। তাদের আলোচনা কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে ঘিরেই ছিলো মূলত। জানা গেছে, বর্তমানে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কারণে, কার্কির নামেই সবুজসংকেত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হিসাবে খ্যাত সুশীলা কার্কি নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক পরিষদের সুপারিশে এই পদে নিয়োগ দেন। বিচার বিভাগে যোগদানের আগে কার্কি একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।