প্রয়াত হলেন প্রখ্যাত দেশের অন্যতম বিশিষ্ট সংগ্রাহক শ্রী পরিমল রায়!
পল্লব মুখোপাধ্যায় : বুধবার ১৬ই অক্টোবর দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে কলকাতা তথা দেশের অন্যতম বিশিষ্ট সংগ্রাহক শ্রী পরিমল রায়ের দেহাবসান ঘটে। আজ বৃহস্পতিবার ১৭ই অক্টোবর কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তাঁর পার্থিব দেহের অগ্নিসংস্কার সম্পন্ন হয়। বয়স ছিল ৮৯। কেউ বলেন পাগলামি, আবার কেউ বা বলেন নেশা। সংগ্রাহকরা চিরকাল এমনই। এনারা আছেন বলেই হয়তো সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে অতীতের অমূল্য সম্পদ। এই শহরে এমন বহু সংগ্রাহকই আছেন। দলিলদস্তাবেজ, মুদ্রা, পোর্সেলিন, পুতুল, পেতলের বাসন, মূর্তি, ডাকটিকিট, চিঠি, বিখ্যাত মানুষদের সই, চাবির রিং, বুকমার্ক, পেনসিল, দেশলাই— এমন আরও কত কী রয়েছে তাঁদের সংগ্রহে। পরিমল রায় এদের মধ্যেই একজন। ভবানীপুর এলাকার ইদানিংকালের আধুনিক বাড়ি গুলোর মাঝে একটি খুদে গলির ভিতরে আদ্যিকালের বাড়িটি যেন ইতিহাস আগলে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ির সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা পরিমলবাবু। বাড়িতে ঢোকার সময়েই মনে হবে এ যেন পুরনো কলকাতা! প্রথমেই নজর কাড়বে পুরনো দিনের এনামেলের সাইন বোর্ড! দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন দেশের মুখোশ আর পেইন্টিং! ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে কোণার ঘরেই পরিমলবাবুর পৃথিবী। এখনও গড়গড়িয়ে বলেন পুরনো দিনের সব গল্প।ছোট্ট ঘরেই অবলীলায় দাঁড়িয়ে সময়।
টেবিলে, দেওয়ালে, তাকগুলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে আঠারো ও উনিশ শতকের জীবন্ত ইতিহাস। সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টার, অবনী ঠাকুরের মেয়ের হাতে বানানো রবীন্দ্রনাথের কবিতার দেওয়াল অ্যাপ্লিকা। কাগজ কেটে বানানো দেওয়াল ছবি। অতি আশ্চর্য এক জিনিস। বহুমূল্যবান। যদিও পরিমলবাবুর সংগ্রহের মূল বিষয় সূচিশিল্প। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক শিল্পকলা। একটু খোলাসা করেই এই অবলুপ্ত শিল্পটি নিয়ে বলা যাক। 'চারুলতা'র প্রথম দৃশ্য মনে পড়ে? ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা! দৃশ্যের শুরুতেই প্রথমে উঠে আসে ছবির কুশীলবদের নাম, তখন চারু ব্যস্ত থাকে স্বামী ভূপতির রুমাল সেলাইয়ে। তার নিপুণ সুচ-সুতো চালনায় এমব্রয়ডারি হুপ বা কাঠের বেড়ি বরাবর ইংরেজি অক্ষর 'বি'র চার পাশ ঘিরে ফুটে ওঠে পাতার মোটিফ। শুধু চারুলতা বললে খানিক ভুল হবে। 'পরশপাথর', 'মণিহারা', 'সমাপ্তি' এবং 'ঘরে বাইরে' ছবিতেও সত্যজিৎ নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গরমণীর এই অসাধারণ গার্হস্থ শিল্পকলাকে। একটা সময় ছিল যখন শেলাইয়ের কাজ শেখা ছিল বাড়ির মেয়েদের বাধ্যতামূলক। উনিশ শতকের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়া শিল্পের ধারাটি আজ অবলুপ্ত। শেলাইয়ের কাজ কেমন হয়, হয়তো এখন অনেকেই জানে না।পুরনো শেলাই শিল্প কেমন ছিল তা জানাতেই একের পর এক সংগ্রহের শুরু এই প্রবীণের। এই মুহূর্তে পরিমল রায় পূর্ব ভারতের সেরা এফেমেরা (ক্ষণস্থায়ী জিনিস) সংগ্রাহক। কয়েন, ডাকটিকিট, ফিল্ম পোস্টার, বুকলেট, লবি স্টিল, এনামেল সাইনবোর্ডের পর এখন তাঁর মন-প্রাণ জুড়ে মা-মাসি-পিসি-দিদা-ঠাকুমাদের হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম। বাল্য বয়স থেকে সংগ্রহের নেশা শুরু। পরিমল রায় যদিও নিজেকে সংগ্রাহক বলতে আপত্তি করেন। তার কথায়, "শৈশবকাল থেকে সব মানুষই শিল্পী।
এক সময়ে কাছাকাছির মধ্যে থাকতেন বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ। যেমন রাজশেখর বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, গণেশ দত্ত, শর্মিলা ঠাকুর, টিঙ্কু ঠাকুর, পরিচালক মৃণাল সেন, শিল্পী রবীন নাথ, বেতারের ‘গল্প দাদুর আসর’-এর বিখ্যাত শিশুশিল্পী পূরবী চট্টোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ ঘোষ এবং সত্যজিৎ রায়ের কাকা সুবিনয় রায়। কাছেই বকুলবাগান রোডে এক সময়ে ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। সময় পরিবর্তনশীল। সব কিছুই এক দিন বদলায়। তবুও পাড়াটায় মিশে আছে মাতৃস্নেহের ছোঁয়া। তার প্রয়ানে সংগ্রহ ও চর্চার এক অপ্রিয় ক্ষতি হল।