মেদিনীপুরের আনন্দপুর থানার বাবা ঝাড়েশ্বরের মন্দির !
অপূর্ব মজুমদার : পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্যতম শৈবতীর্থ কানাশোলের ঝাড়েশ্বর মন্দির। পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুর থানার কানাশোলে ঝাড়েশ্বর শিবের প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন মন্দির রয়েছে। প্রাচীন টেরাকোটার মন্দিরটি ভীষণ দৃষ্টিনন্দন। নাড়াজোল এর রাজাঅযোধ্যা রাম খানের দেওয়ান রামনারায়ন জানা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। লোকশ্রুতি আছে- মন্দির প্রতিষ্ঠার পূর্বে এইখানের জঙ্গলে এক কৃষ্ণ গাভী বটগাছের নিচে এক জায়গায় রোজ দুধ দিত। এক রাখাল বালক সেটি দেখতে পায়। ঠিক ওই দিন রাত্রে ব্রাহ্মণ ভূমের রাজা আলালনাথ দে, ওই গাভীর মালিক এবং আড়িয়াদহের শীতলানন্দ মিশ্র তিনজনই স্বপ্নাদেশ পান! ওই বটগাছের নিচে রয়েছে অনাদি লিঙ্গ। সেই লিঙ্গ কে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পেয়ে বট গাছের নিচ থেকে লিঙ্গ খনন করা হয় এবং ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দের ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তে এই প্রাচীন শিব বাবা ঝাড়েশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।এই প্রাচীন শিব মন্দির টি টেরাকোটার। মূল মন্দিরের পাশে মহাকাল ভৈরবের থান , ভোগ মন্ডপ, নাটমন্দির আছে। প্রাচীন বটের ছায়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশে বাবা ঝাড়েস্বর অধিষ্ঠান করছেন।মন্দির এর পেছনে বিরাট আলাল দিঘি। ব্রাহ্মণ ভূমের রাজা আলালনাথ দেবএই জলাশয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই নদীয়াল দেব দাদার স্মৃতিতে ওই জলাশয় এর মধ্যে এক মাকডা পাথরের জলহরি মন্দির তৈরি করেন যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। অনাদি লিঙ্গের পেছনের পূর্বপাশে দেওয়ালে অষ্টাদশভূজা মা দুর্গার মূর্তি খোদিত আছে। নাড়াজোল রাজবংশের কুলদেবী ইনি।গাজন, শিবরাত্রি ,শ্রাবণী মেলা, ও দুর্গাপূজার সময় এখানে বিরাট মেলা বসে। উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে ভক্তরা।আমাদের কাছেই রয়েছে এই প্রাচীন শৈবতীর্থ।পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আনন্দপুর থেকে টোটো বা গাড়িতে ১০ মিনিট কানাশোল বাবা ঝাড়েশ্বর মন্দির! মেদিনীপুর শহর থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিমি। মন্দিরের নির্মাণ শৈলী নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় এটি একটি ৬৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি বাঁকানো কার্নিশযুক্ত পঞ্চরত্ন মন্দির।মন্দিরগাত্রে রয়েছে অসংখ্য পোড়ামাটির কাজ|পোড়ামাটির মূরতিগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি,রাধাকৃষ্ণের লীলা,রামায়ণের কাহিনী,দশাবতার,মিথুনদৃশ্য সহ বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী।মন্দিরের প্রশস্ত গর্ভগৃহে রয়েছে শিবের গৌরীনট বেষ্টিত শিবের অনাদি লিঙ্গ ও দেওয়ালে চালচিত্রের মধ্যে অষ্টাদশভূজা মা দূর্গার প্রতিকৃতি। মূল মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাকাল ভৈরবের থান,নাটমন্দির, ভোগমন্দির ও নেতনালা। জানা যায় ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে সনাতন চৌধুরী আটচালা রীতির এই ভোগমন্দিরটি তৈরি করেন।
মন্দিরের পেছনেই রয়েছে ১৪ একরের এক বিশাল দিঘী যেটি রাজা আলালনাথ দেব খনন করেন। রাজা আলালনাথ দেবের নাম অনুসারে এই বৃহৎ দিঘীটি “আলাল দিঘী” নামে পরিচিত।রাজা আলালনাথ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই নদীয়ালদেব দাদার স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিঘীর মাঝখানে মাকড়া পাথরের “জলহরি” মন্দির নির্মাণ করেন|তবে দেখভাল ও পরিচর্যার অভাবে জলহরি মন্দিরটি এখন লুপ্তপ্রায়| নিকটবর্তী রেলস্টেশন গোদাপিয়াশাল (১৩ কিমি)। তবে মেদিনীপুর থেকে বাসে (২৫ কিমি) যাওয়া সুবিধাজনক। নিজের গাড়িতে গেলে কোলকাতা (দূরত্ব-১৪০কিমি) থেকে কোলাঘাট পেরিয়ে মেচগ্রাম থেকে ঘাটাল রুট ধরে বকুলতলা, ওখান থেকে আবার বামদিকের রাস্তা ধরে নাড়াজোল, কেশপুর হয়ে আনন্দপুর পৌঁছানো যাবে। তবে আমি বাইকে গিয়েছিলাম একটু শর্ট রাস্তায়, পাঁশকুড়া থেকে আষাঢ়ি (NH-6) মোড়ের ডানদিকের রাস্তা ধরে লোয়াদা-গোলগ্রাম-মলিঘাটি-নাড়াজোল-কেশপুর হয়ে আনন্দপুর পৌঁছাই। চৈত্র সংক্রান্তির আগে গাজনের মেলা ঘিরে উত্সবের মেজাজ কানাশোলে। শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর নয়, ভিন্ জেলা থেকেও পুণ্যলাভের আশায় এখানে আসেন বহু মানুষ। শিবের মাথায় জল ঢালেন, পুজো দেন।