পৃথিবী - সুনীল মাজি
দাঙ্গা লেগে গেল সুর অসুর দুই প্রজাতির মধ্যে। লড়াইটা সুখ আর ভোগ নিয়ে। এই সুখভোগ এর আরেক নাম নিরাপত্তা। কেউ বলেন, ধর্ম সেই নিশ্চিন্তপুর। কুলকুল করে এক নদী বইছে। তিরতির করে গাছের পাতা নড়ছে। চ ই চ ই ভাসছে। সুর এর এক প্রবাহ লিখছে অক্ষর ছন্দ। এইসব দেখে শব্দ করছে অসুর এর দল। তারা অক্ষর পাচ্ছে না। অপ্সরা পাচ্ছে না। তাই হাঙ্গামা করছে। এটাই রাজনীতি।আমি পিতামহী সুবালাকে জিজ্ঞেস করি, কতগুলো স্বর্গ আছে? পিতামহী বলেন, সংখ্যা আমি জানি নে। তুমি তোমার দাদুভাইকে জিজ্ঞেস কোরো। তবে সংখ্যায় অনেক অজস্র। মঙ্গল আছে বুধ আছে বৃহষ্পতি আছে।পিতামহী বলেন, শুক্র শনি এরা স্বর্গ নয়।আমি জিজ্ঞেস করি, এরা কী ?—এরা অস্বর্গ।—তুমি যাদের কথা বলছ, ওরা তো গ্রহ। দাদু যে বলেন, যার নিজস্ব আলো আছে সে-ই স্বর্গ। সে-ই দেবতা। সে-ই নক্ষত্র। যে মানুষের নিজস্ব আলো আছে সে-ই দেবতা।পিতামহী তার স্বামী দেবতার কথায় কানের দুপাশে হাত দেয়। বুকে দুটো হাত জোড় করে। এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। এটাই আধ্যাত্মিকতা।আমি তখন আবার পিতামহকে জিজ্ঞেস করি, ঠাগমা যে বলছিল সুর অসুর ছিল তারা-গ্রহের বাসিন্দা, সত্যি?পিতামহ বলেন দারুন সত্যি—ভীষণ সত্যি। ওখানে ওরা থাকে অশরীরী। মাঝে মাঝে নেমে আসে এই পৃথিবীতে। দেবতারা সংখ্যায় বেশি হলে এই চরাচরে সুখ সমৃদ্ধি নামে শান্তি নামে। আর দানবরা সংখ্যায় বেশি হলে খরা মহামারী দুর্ভিক্ষ যুদ্ধ।—দেবতা কখন নামে?—যে মায়ের গর্ভ শুদ্ধ।—শুদ্ধ গর্ভের নারী কাকে বলে?—যার তনমন পৃথিবীর মঙ্গল।—কে মঙ্গলা?—যিনি গৌরী— গৌরী মাতা।–দেবতাদের সংখ্যা কেন কমে—অসুরদের ভয়ে?—নিজের দোষে — জন্মে সুর কর্মে অসুর অপ্সরা হাসে।—মানে?—অপ্সরা হলো ভোগের শরীর। সেই শরীর হলো নেশা। সেই নেশাভাণ্ড নিয়ে লড়াই।—তবে যে যুদ্ধের কারণের পেছনে ন্যায় অন্যায় বা ধর্ম বা অস্তিত্বের সংকটের কথা বলা হয়?—সেটাও সত্যি। যখন তুমি বর্তমান ও শরীরের বাইরে কিছু নও। যখন তুমি যুদ্ধের মধ্যে জন্মাবে তুমি যুদ্ধবাজ হবে। যখন শান্তির মধ্যে জন্মাবে তখন শান্তিময় হবে। চাঁদ হবে। জ্যোৎস্নাময় হবে।চারপাশে এই যুদ্ধ যুদ্ধ অভিনয় অভিনয় চোর চোর লুঠ লুঠ পরিবেশে ভাবি এরা কাদের সন্তান? কোন্ মায়ের সন্তান?এদের জননী নেই। এরা ভোগের সন্তান। এরা ভুল ভুল মিথ্যা মিথ্যা জন্মায়। এরা রাহুর মতো চাঁদ খায়। পৃথিবীর মঙ্গল চুরি করে। শান্তি লুঠ করে। পৃথিবীর ঐশ্বর্য পাচার করে। ভাবো, কে তুমি? আছে কি তোমার মাতৃপরিচয়? হায়, গাভীর মতো মেঘ চুরি যায়। কবিতা : চাঁদ চাঁদটা ভেঙে যেতেই মানুষের মধ্যে আর বিশ্বাস নেই।মানুষ দেখতে পাচ্ছে তাদের স্মৃতি লোপ পাচ্ছে দ্রুত!স্মৃতিহীন মানুষ খুন করতে পারে বাপকে মাকে, এমনকি নিজেকেও।সে হারিয়ে ফেলে আত্মপরিচয়–– সে জানে না রাষ্ট্র বা দেশ কাকে বলে।দাঙ্গা এবং যুদ্ধ লাগিয়ে সে খা খা হাসতে পারে—সঙ্গীকে ফেলে দিতে পারে চোরাবালিতে।যার চাঁদ নেই তার কোনো স্বপ্ন নেই,একজন স্বপ্নহীন মানুষের না থাকে আলো না থাকে ছায়া,আলোকে সে আগুনের উত্তরসূরি বলে ভয় পায়,ছায়াকে সে অন্ধকারের উত্তর-প্রজন্ম বলে ভয় পায়,যার বুকে ভয় থাকে তার আকাশে কোনো চাঁদ ওঠে নাযার বুকে চাঁদ নেই তার থাকে না প্রেমের স্বরলিপিকেননা পাখির গান নেইকোনো জলের ঢেউ নেইবাতাস ইথার শূন্য বলে সেখানে তরঙ্গ জাগে নাএকজন তরঙ্গহীন মানুষ সর্বদাই বুলেট বন্দুক গ্রেনেড মিসাইলের পাহারায় থাকেসে এক লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যহীন যুদ্ধের মধ্যে থাকতে চায়।চাঁদ ভেঙে গেলে একজন মানুষ অকবি, শিল্প-মৃতপ্রায়।