ঐতিহ্যবাহী মহিষাদল রথযাত্রা!
পূর্ব মেদিনীপুর নিজস্ব সংবাদদাতা : শ্রী ভগবতীচরণ প্রধান ১৮৯৭ সালে তাঁর 'মহিষাদল রাজবংশ' বইতে উল্লেখ করেন--"মহিষাদলের রথ বঙ্গের একটি প্রধান দৃশ্য। ইহার উৎসব উপলক্ষ্যে নানা স্থানের ব্যবসায়ীগণ স্ব স্ব পণ্যদ্রব্য আনয়ন করে। সপ্তাহকাল ব্যাপিয়া নরস্রোত জলস্রোতের ন্যায় যেন কেন্দ্রাভিমুখে ধাবিত হইতে থাকে। রাজপথ মস্তকময় হইয়া উঠে। উৎসবভূমি যেন একটি সঞ্চরমান মস্তকময় ক্ষেত্ররূপে প্রতীয়মান হয়।" বাংলার শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মহিষাদলের রথযাত্রা সম্পর্কে ভগবতীবাবুর বর্ণনা একটুও অতিশয়োক্তি নয়। প্রায় ২১৬ বছর ধরে চলা এই রথযাত্রা বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম গর্ব। বলা হয় পুরী, মাহেশের পরেই মহিষাদলের রথ তার ব্যাপকতায় ও বৈচিত্র্যে অনন্যতা দাবি করে।
মহিষাদলের রথযাত্রা মহিষাদল রাজপরিবারের অবদান। আজও রাজপরিবারের ভূমিকাই প্রধান। পুরীর রথ প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো, মাহেশের রথ চলা শুরু করেছিল আনুমানিক ১৫১০ থেকে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মহিষাদলের রথযাত্রার সূচনাবর্ষ নিয়ে সামান্যতম হলেও বিতর্ক আছে। কোনও কোনও প্রাবন্ধিক যদিও মনে করেন ১৭৭৬ সাল নাগাদ মহিষাদল রথযাত্রার প্রবর্তন করেছিলেন মহিষাদল রাজ পরিবারের অন্যতম দক্ষপ্রশাসক রানি জানকী, কিন্তু প্রামাণ্য ইতিহাস বলে মহিষাদল রথযাত্রা শুরু করেছিলেন জনৈক মতিলাল পাঁড়ে যিনি রানি জানকী এবং প্রয়াত রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের পোষ্যপুত্র। রানি জানকীর মৃত্যুর পর ১৮০৪ সালে এই রথের সূচনা করেন। তবে রানি জানকী সম্ভবত রথের পরিকল্পনা প্রথম করেন।
পুরীর রথযাত্রার অনুকরণে আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে যে রথযাত্রার সূচনা হল তা ছিল কাঠের সতেরো চূড়ার রথ। তখনকার দিনে তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০০০ সিক্কা টাকা। রথটি বর্গাকার হয়ে কৌণিক ভাবে উঠে গেছে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩২ ফুট। দ্বিতীয় তলের দৈর্ঘ ও প্রস্থ ২৫ ফুট। তৃতীয়তল ২০ ফুট, চতুর্থ তল ১৫ ফুট। পঞ্চম তলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হল ১০ ফুট। চৌত্রিশটি কাঠের চাকা একলাইনে নেই যাতে দু-চারটি চাকা খারাপ হলেও রথ চলাচলে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। চাকাগুলো উচ্চতায় চার ফুট আর বেড় বারো ফুট। চারখণ্ড কাঠ দিয়ে একএকটা চাকা তৈরি। প্রতিবছর অন্তত দুটো করে চাকা মেরামত করা হয়। সমস্ত রথে মোট বাহান্নটি খুঁটি আছে যার মধ্যে চারটে মোটা খুঁটি রথকে ধরে রাখে। চারটে খুঁটির মাঝে আছে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। রথের প্রত্যেক তলের চারিদিকে হেঁটে চলাফেরাও করা যায়।
এখন যে রথটি মহিষাদলের রথতলা থেকে গুণ্ডিচাবাড়ি যায় তার উচ্চতা এক থাকলেও চূড়ার সংখ্যা কমে তেরো হয়েছে। কথিত আছে 1860 সালে রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গের জনৈক ফরাসী বন্ধু মঁসিয়ে পেরু রথ দেখতে আসেন এবং তখনই তিনি রথের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য একটি নকশা করেন। নকশায় যোগ হয় চারিদিকের ঝুলবারান্দা ও চারকোণের চারটি ঋষি মূর্তি। চূড়ার সংখ্যা কমে হয় তেরো। কলকাতা থেকে কারিগর গিয়ে সংস্কারের কাজটুকু করে। সঙ্গে হাত লাগায় দেশি ও চিনা কারিগররা। সেই থেকে বছরের পর বছর রথসংস্কার চলছে মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে। শুধুমাত্র রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ দুটো সাদা ঘোড়া রথের আগে যোগ করেন। মহিষাদল রাজাদের অন্যান্য স্হাপত্যের মতো রথটির কাঠের কাজ মনোমুগ্ধকর। রথের কোণে কোণে লতাপাতার নকশার বদলে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি জানোয়ারের উপর বর্শা হাতে সৈন্য বা নর্তকীদের মিছিল দেখা যায়। তারাপদ সাঁতরার মতো গবেষক এগুলিকে 'মৃত্যুলতা ভাস্কর্য' বলে অভিহিত করেছেন।
প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রা একটু হলেও অভিনবত্বের দাবি রাখে। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে রথে আরোহণ করেন রাজবংশের আরাধ্য দেবতা গোপাল জিউ। (এই গোপাল জিউকে রানি জানকী স্বপ্নাদেশ পেয়ে এক মাঠের মাঝখান থেকে উদ্ধার করেন। তাঁকে কাকতাড়ুয়া করে রাখা হয়েছিল।) সঙ্গে থাকেন কেবলমাত্র জগন্নাথদেব। ঠিক আগের দিন রাজবংশের আরাধ্য শালগ্রাম শিলা 'শ্রীধর জিউ'কে রথে এনে 'রথের চক্ষুদান' উৎসব হয় যা 'নেত উৎসব' হিসেবে বহুল জনপ্রিয়। আটাশ থেকে তিরিশ কিলোগ্রাম ওজনের এক একটি পিতলের কলস ও দশ থেকে বারো কেজি ওজনের এক একটি চক্র রথের চূড়ায় লাগানো হয়। রথের দিন শোভাযাত্রা করে জগন্নাথ দেব, গোপাল জিউ ও শ্রীধর জিউকে নিয়ে এসে রথের ওপরে বসানো হয়। পুরীর রথে টান পড়লেই রাজবাড়ির কেউ পালকি করে এসে রথের রশিতে টান দেন। অসংখ্য ভক্তের প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে রথ এগিয়ে চলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গুণ্ডিচাবাড়ির দিকে।
সাতদিন গুণ্ডিচাবাড়িতে উৎসব চলে। জগন্নাথেরও বেশ পরিবর্তন হয় দিন ধরে ধরে। জমজমাট রথের মেলা চলে প্রায় পনের দিন। এ রথ মূলত বিখ্যাত আম-কাঁঠাল, মাদুর, চারাগাছের জন্য। কয়েকদিন ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হত। যখন বাসরাস্তা চালু হয়নি তখন দূর দূরান্তরের মানুষজন নৌকো করেই আসতেন। হিজলি টাইডেল ক্যানালে বাঁধা থাকত সার সার নৌকা। কয়েকশ লরি আসত কাঁঠাল বোঝাই করে। দোকানে দোকানে বড়, ছোট, পাকা, খাজা কাঁঠালের সে স্তূপ দেখার মতো। মেলার দিনগুলিতে সেগুলো মানুষের মাথায় করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেত। না হলে কলেজ-স্কুল প্রাঙ্গনে কাঁঠাল-মুড়ি সহযোগে একপ্রকার ছোটখাটো বনভোজনের ব্যবস্থা। মেলার প্রধান আকর্ষণ মৃৎশিল্প, নাগরদোলা, সার্কাস। সারি সারি দোকান। মাটির জিনিস থেকে লোহার সাংসারিক জিনিস। কী নেই তাতে! গরম গরম জিলিপি, বড় বড় পাঁপড়ভাজা, হাওয়া মিঠাই, মিষ্টি। কলকাতার বড় বড় যাত্রাপার্টি গুণ্ডিচাবাড়িতে যাত্রা পরিবেশন করত। তবে এখন কাঁঠালের স্তূপ আর এত বড় হয় না, বিভিন্ন লোকালয়ে অসংখ্য ছোটখাটো রথের উৎপত্তির কারণে জনসমাগম সামান্য কমে গেছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে বরাবর অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে মহিষাদল। বিয়াল্লিশের 'ভারত ছাড়' আন্দোলন তো এক অন্যরকম মাত্রা পেয়েছিল মহিষাদলে। ১৯৪২ –এর ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয়েছিল স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সেই আন্দোলনেও জড়িয়ে গেছে প্রাচীন এই রথযাত্রা। প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী নীলমণি হাজরা (কাকাবাবু)'র ডায়েরি 'স্মৃতির ভেলা' থেকে জানা যায় ১৯৩২ –এ রথে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর দাবিতে রথটানা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এক উত্তাল সময়। কাকাবাবুর ডায়েরি 'স্মৃতির ভেলা' থেকেই তুলে দিলাম--- "রথমেলার পূর্ব হতে মদ, তাড়ি ও বিদেশী বস্ত্রের দোকানে পিকেটিং হচ্ছিল। রথমেলায় জোর পিকেটিং চলতে লাগল। পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে থানায় ভীষণ ভাবে প্রহার করে ছেড়ে দিতে লাগল। রথের দিন মদ দোকানে গোয়ালবেড়্যা গ্রামনিবাসী শ্রী ফণীন্দ্রনাথ পাঞ্জা পিকেটিং করতে থাকে। তাকে পুলিশ ধরতে এলে সে রাস্তার উপর শুয়ে পড়ে। পুলিশ তার দু'পা ধরে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায়। সর্বশরীর রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে। সমস্ত মানুষ ক্ষেপে ওঠে। মেলাতে প্রায় পাঁচশ স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকা উপস্থিত হয়। স্বেচ্ছাসেবক এবং স্বেচ্ছাসেবিকারা জাতীয় পতাকা হাতে প্রচার করতে লাগলেন। এই সব দেখে বর্বর পুলিশ তাদের উপর যে অত্যাচার চালায়, তা বর্ণনাতীত।"
পুলিশের অত্যাচারের বর্ণনা প্রচার করার সময় পুলিশ সুতাহাটা থানার শ্রীমতী সুবোধবালা কুইতিকে গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে সবাই বিদ্রোহ করে বলতে থাকে রথের ওপর জাতীয় পতাকা না ওড়ালে রথ টানা হবে না। প্রায় দু'শ হাত যাওয়ার পর সবাই রথের রশি ছেড়ে দিল। রথ দাঁড়িয়ে পড়ল। মানুষ রথে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে এককাট্টা। রাজপরিবার, পুলিশের কোনও অনুরোধেই কাজ হল না। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করার সাহস গর্গ পরিবারের ছিল না। বেগতিক বুঝে রাজার গড়ে আরেকটি যে ছোট রথ ছিল সেটি নিয়ে এসে বিগ্রহ বড় রথ থেকে নামিয়ে সেই রথে স্হাপন করে জগন্নাথদেবকে গুণ্ডিচাবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। আটদিন পর ফের সেই ছোট রথে করেই জগন্নাথদেব রাজবাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। বড় রথ পড়েই থাকে একইভাবে। বর্ষা শেষ হলে প্রায় একহাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে মাথাপ্রতি এক টাকা করে দিয়ে রথকে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়।
এখন মেদিনীপুর জেলার বহু স্হানে স্হানীয় ভাবে রথের মেলার প্রচলন হয়েছে তবুও মহিষাদলের এই রথযাত্রার আবেদন, গরিমা এবং ঐতিহ্য আজও অমলিন। সম্প্রতি রথটির আমূল সংস্কার হয়েছে। যদিও মেলার ধরন একটু হলেও পাল্টে গেছে, আগেকার মত এত দোকানপাট আর বসে না। আশা করা যায় সাধারণ মানুষের শুভকামনা ও আন্তরিক অংশগ্রহণে এই প্রাচীন রথযাত্রা বাংলার সংস্কৃতিকে আরও সম্পৃক্ত করবে। এগিয়ে যাবে বছরের পর বছর।