পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস !

নিজস্ব সংবাদদাতা : জগন্নাথপুরী ভারতের চারটি ধামের মধ্যে একটি। কথিত আছে যে অন্য তিনটি ধাম পরিদর্শন করার পরে এখানে আসা উচিত। পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দির, উড়িষ্যা রাজ্যে অবস্থিত, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির যা বিশ্বের প্রভু শ্রী কৃষ্ণকে উত্সর্গীকৃত। জগন্নাথপুরীকে পৃথিবীর বৈকুণ্ঠ বলা হয়, এই স্থানটিকে শাক্ষক্ষেত্র, নীলাঞ্চল ও নীলগিরিও বলা হয়।পুরাণ অনুসারে, ভগবান কৃষ্ণ পুরীতে নীলমাধব রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ওড়িশায় অবস্থিত এই ধামটিও দ্বারকার মতো সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। জগতের ভগবান এখানে তাঁর বড় ভাই বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রার সঙ্গে বসে আছেন। তিনটি দেবতার মূর্তিই কাঠের তৈরি। প্রতি বারো বছর পর পর এসব মূর্তি পরিবর্তন করার বিধান রয়েছে। পবিত্র গাছের কাঠ থেকে প্রতিমাগুলির প্রতিলিপি তৈরি করা হয় এবং সেগুলিকে আবার জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র করা হয়। বেদ অনুসারে ভগবান হলধর হলেন ঋগ্বেদের রূপ, শ্রী হরি (নৃসিংহ) হলেন সামদেবের রূপ, সুভদ্রা দেবী হলেন যজুর্বেদের রূপ এবং সুদর্শন চক্রকে অথর্ববেদের রূপ বলে মনে করা হয়। এখানে শ্রী হরি দয়াময় রূপে বিরাজমান। বর্তমান মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন কলিঙ্গ রাজা অনন্তবর্মণ চোদাগঙ্গাদেব।
কথিত আছে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মহাপ্রসাদের এমনই মহিমা যে, কোনও দিন সেখানে প্রসাদ বাড়তিও হয় না, আবার নষ্টও হয় না। পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে ব্যবহৃত হয় না কোনও প্রকারের ধাতব বাসনপত্র। এই মন্দিরে কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও নেই। মহাপ্রসাদের জন্য পুরো রান্নাটাই করা হয় মাটির পাত্রে। এখানে কোনও পুরনো পাত্রে রান্না করা হয় না, প্রতি দিন নতুন নতুন পাত্রেই রান্না হয়। এক দল খালি মাটি দিয়ে পাত্র বানায়, আর এক দল তা সরবরাহ করে রান্নাঘরে নিয়ে যায়।
বছরের ৩৬৫ দিন জগন্নাথ মন্দিরের পিছনে একটি বিরাট হেঁশেলেই তৈরি হয় ভোগ। একে রোসাঘর বলে। মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রোসাঘরের অবস্থান। রোসাঘরে রয়েছে ৭৫২টি উনুন। হেঁশেলে ভোগ তৈরির কাজ করেন প্রায় ৬০০ জন রাঁধুনি ও তাঁদের সাহায্যের জন্য থাকেন প্রায় ৪০০ জন সেবক।

রোসাঘরটি প্রায় ১৫০ ফুট লম্বা, ১০০ ফুট চওড়া। হেঁশেলের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। হেঁশেলের মধ্যে প্রায় ৩২টি কক্ষ রয়েছে। এখানে রান্নার পদ্ধতিটিও বেশ অভিনব। প্রতিটি উনুনের একটি করে বড় মুখ। তার চারপাশে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মুখ থাকে। উনুনের মুখে সবচেয়ে বড় মাটির হাঁড়িতে অন্ন বসানো হয়। তার উপরে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত ক্রমশ ছোট হতে থাকা হাঁড়িতে নানা ধরনের তরকারি, পায়েস রান্না হয়।

একেবারে নীচের পাত্র থেকে ওঠা বাষ্পের ভাপে রান্না হয় উপরের পাত্রগুলিতে থাকা শাকসব্জি, অন্ন এবং মিষ্টান্ন । রান্নার সময়ে অন্ন কিংবা শাকসব্জিতে কোনও ভাবেই হাত দেওয়া হয় না বা নাড়াচাড়া করা হয় না। প্রত্যেকটি পাত্রে আলাদা আলাদা ভোগ রান্না করা হয়।

বিস্ময়কর ভাবে সবার আগে সবচেয়ে উপরে থাকা পাত্রটির রান্না শেষ হয়। তার পরে রান্না শেষ হয় তার ঠিক নীচে থাকা পাত্রটির। এ ভাবে সব শেষে সুসিদ্ধ হয় উনুনের উপরে রাখা শেষ হাঁড়ির ভোগ।

মাটির হাঁড়ির মধ্যে মূলত ফুটন্ত জলে সব্জি এবং মশলা দিয়ে চলতে থাকে মহাপ্রভুর রান্না। চিনি নয়, রান্নায় ব্যবহার করা হয় গুড়। এ ছাড়া, কোনও রকম গুঁড়ো মশলা নয়, বাটা মশলার ব্যবহার হয়। মশলার মধ্যে মূলত থাকে এলাচ, বড় এলাচ, দারচিনি, গোলমরিচ, আদা, কালো সর্ষে, জোয়ান, লবঙ্গ, জায়ফল, হলুদ, নুন। জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার জন্য রোজ ৫৬টি পদ রান্না করা হয় রোসাঘরে। এই পদগুলিকে মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। ‘পাক্কা’ এবং ‘সুক্কা’ নামে ডাকা হয়। ‘পাক্কা’ বলা হয় সেই খাবারগুলিকে, যেগুলি সেদ্ধ করা হয়। যেমন ডাল, চাল, খিচুড়ি এবং সব রকমের সব্জি। অন্য দিকে, ‘সুক্কা’ বলা হয় গজা, মিষ্টি আর বিভিন্ন ধরনের পিঠেকে।

পাল্টে যান জগন্নাথদেবের মন্দিরের রাঁধুনিরা। পাল্টায় না শুধু জগন্নাথ মন্দিরের রন্ধনশালায় তৈরি হওয়া ভোগের স্বর্গীয় স্বাদ। কী ভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রসাদের স্বাদ এক থাকে, তা অবাক করে ভক্তদের।