"অলীক সফটওয়্যার কোম্পানি" - রতনতনু ঘাটী

অনেকদিন পরে আজ অনিলেশের সঙ্গে দেখা
তেরো মাথার মোড়ের উদয়পদ্ম গাছটার নীচে।
অনিলেশ বলল, ও নাকি রোজ এখান থেকেই
সেক্টর নাইন্টি-নাইনের বাস ধরে,
ওর কোম্পানির নাম অলীক সফটওয়্যার।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলাম,
এ কি সেই অনিলেশ, যে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়
আমার একটা সুগন্ধি ইরেজার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি?

ওর হাতের টিফিনবক্সের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালাম?
অনিলেশ বলল, এতে নানা রঙের রূপকথা ভরে দিয়েছে ওর বউ।
বাইরে কিচ্ছু খেতে দেয় না,
তাই এইসব রূপকথা খেয়েই ওর সারাদিন কাটে!
আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম,
এ কি সেই অনিলেশ, যে মেয়েদের সামনে
নিজের নামটাই ঠিকঠাক মনে করতে পারত না?

একথা-ওকথার পিঠে জানতে চাইলাম, ছেলেমেয়েরা?
অনিলেশ বলল, এক ছেলে দুন স্কুলে পড়ে,
ওর বিষয় ভোরবেলার স্বপ্ন!
আর এক মেয়ে বিকেলবেলার রামধনু নিয়ে
বিশ্বভারতীতে মাস্টার্স করছে, সেকেন্ড ইয়ার।
আমি মনে মনে বললাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যে অঙ্কে তেরো পেত, আর বাংলায়
কখনও ভাবসম্প্রসারণ লিখতেই পারত না?
বললাম, কদম্বগাছিতে থাকিস,
ওখানে ফ্ল্যাট না নিজের বাড়ি?
অনিলেশ বলল, যমুনাবতী নদীর পাড়ে
মধুমঞ্জরী লতায় ঢাকা দোতলা বাড়িটাই তো,
বাড়ির নাম আকাশকুসুম!
আমার মনে পড়ে গেল, যে ছেলেটা খালধারের হতকুচ্ছিত
একটা বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকত, এ কি সেই অনিলেশ?
জানতে চাইলাম, এতটা পথ... গাড়িটাড়ি কিনিসনি?
ও বলল, ওর দুটো গাড়ি আছে,
একটার নাম পুষ্পক, আর-একটার নাম অন্তরীক্ষ!
গাড়িতে গেলে মানুষ একলা হয়ে যায়,
তাই বাসে যাতায়াত করে।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম,
এ কি সেই অনিলেশ, যার হাওয়াই চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে
অনেক দিন খালি পায়ে স্কুলে আসত?
বললাম, অফিস চলে গেলে বউ সারাদিন কিছু...
অনিলেশ জানাল, অফিস যাওয়ার সময় ও বউকে
নতুন কিছু করতে বলে যায়,
আর সরোদে-সেতারে, তানপুরায়-বেহালায়, বীণায়-এস্রাজে
ওর বউ সারাদিন নতুন নতুন সুর রচনা করে।
শুনে আমি ভাবলাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যে ভুল বানানে মীতাক্ষরীকে প্রেমপত্র লিখে
বাংলাস্যারের হাতে ধরা পড়ে বকুনি খেয়েছিল?

বললাম, মেসোমশাই, মানে এখন...
অনিলেশ বলল, ও, বলাই হয়নি!
বাবার মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল,
বাবা দিনেরবেলা আকাশে তিনটে সূর্য
আর রাতেরবেলা চারটে চাঁদ দেখতে পেত।
ছেলেমেয়ের পড়ার ক্ষতি হচ্ছিল,
তাই বাবাকে আর বাড়িতে রাখাই গেল না!
নিজের মনে বললাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যার বই কিনে দেওয়ার জন্যে তার বাবা
লোকের বাড়ি-বাড়ি সাহায্য চাইতে যেতেন?

অনিলেশ চলে যাওয়ার জন্যে উসখুশ করছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, আর মাসিমা?
অনিলেশ বলল, আর বলিস না!
সংসারে মানিয়ে নিতে পারল না বলে
মাকে একটা বৃদ্ধাবাসে রেখে এসেছি।
ওখানে কাগজের ঠোঙা তৈরির টাকায়
আমার এবারের জন্মদিনে মা একটা জামা পাঠিয়েছিল,
কিন্তু বিশ্বাস কর, এত অর্ডিনারি, জাস্ট পরা গেল না!
আমি চেঁচিয়ে বললাম, তুই কি সেই অনিলেশ,
যার জন্যে বাঁশের বেড়ার ঘরের দরজায়
মাসিমা ভাতের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সারাদিন?

আমার কথাগুলো শুনতেই পেল না, দৌড়ে বাসে উঠে গেল অনিলেশ,অলীক সফটওয়্যার কোম্পানির ম্যানেজার।