গুরু-শিষ্য পরম্পরা: শিক্ষক দিবসের অনুপ্রেরণা - ত্রিশূলকণ্ঠ
আজ ৫-ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন । তিনি শিক্ষা কে জীবনের অন্যতম স্তম্ভ বলে মনে করতেন।এই দিনে একটা পুরনো গল্পের কথা মনে পড়ছে—এক চিরন্তন কাহিনি, আমাদের গুরু-শিষ্য পরম্পরার। এটি সেই তানসেনের কাহিনি, ভারতীয় সংগীতের প্রতীক, এবং তাঁর গুরু স্বামী হরিদাসের।অনেক দিন কেটে গেছে, কিন্তু এই কাহিনি ভারতবর্ষের গুরু-শিষ্য পরম্পরার অন্তঃস্রোতে আজও বেজে চলে। তানসেন—নামটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভারতীয় সংগীতের মহিমা। মোগল সম্রাট আকবরের সভায় তিনি ছিলেন রাজ-গায়ক, নবরত্নের এক রত্ন। একদিন তাঁর গান শুনে সম্রাট আকবর মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তানসেন, তোমার গুরু কে ছিলেন?” “স্বামী হরিদাস, মহারাজ,” বিনীতভাবে উত্তর দিলেন তানসেন। আকবর আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তিনি কি তোমার মতোই মহাগায়ক?” তানসেন বিনয়ে মাথা নত করে বললেন, “আমাকে আমার গুরুর সঙ্গে তুলনা করা—এই চিন্তাই আমার অপরাধ। তিনি শুধু গায়ক নন, তিনি স্বয়ং সংগীত।” আকবর বিস্মিত হলেন। “তবে আমি তাঁর গান শুনতে চাই।”তানসেন বললেন, “কিন্তু তিনি কখনো রাজসভায় গান গাইতে সম্মত হবেন না।”আকবর দৃঢ়স্বরে বললেন, “তবে আমি তোমার সঙ্গে যাব, তোমার দাসের ছদ্মবেশে।”দূরপথ পেরিয়ে তানসেন ও আকবর পৌঁছলেন স্বামী হরিদাসের আশ্রমে—সংগীতের সেই পবিত্র কুটিরে। গুরু তাঁদের সস্নেহে অভ্যর্থনা জানালেন, কিন্তু কিছুই বললেন না।তিন দিন কেটে গেল নীরবতায়।
অবশেষে, একদিন ভোরের আলো ফুটবার আগমুহূর্তে স্বামী হরিদাস গাইতে শুরু করলেন।আকবর ও তানসেন হতবাক হয়ে গেলেন। সেই সুর যেন কোথা থেকে শুরু হয়েছে তার সন্ধান মেলে না, কোথায় শেষ হবে তারও ঠিকানা নেই। মনে হল বৃক্ষ, পাথর, প্রাণ—সবই সংগীতে বিলীন হয়ে গেছে। যখন মায়ার আবেশ ভাঙল, তাঁরা দেখলেন কুটির শূন্য।
“তিনি কোথায় গেলেন?” বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন আকবর। তানসেন দুঃখভরে বললেন, “তিনি এই স্থান চিরতরে ত্যাগ করেছেন। হয়তো ভেবেছেন, আবার আমরা এসে তাঁকে বিরক্ত করব।”নীরবে তাঁরা ফিরে এলেন প্রাসাদে। কিন্তু আকবরের মনে সেই সুরের অনুরণন থেকে গেল।কয়েকদিন পর তিনি তানসেনকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সেই রাগ জানো?” “হ্যাঁ, মহারাজ, আমি তাঁর কাছেই শিখেছি,” উত্তর দিলেন তানসেন। আকবর অনুরোধ করলেন, আর তানসেন গাইলেন তাঁর সেরা সাধনার গান।কিন্তু সম্রাটের মন ভরল না। তিনি বললেন, “তানসেন, তুমি অনবদ্য গান গাইলে, তবু কেন তোমার গানে সেটা নেই, যা স্বামী হরিদাসের কণ্ঠে ছিল?” তানসেন বিনম্র স্বরে উত্তর দিলেন, “মহারাজ, আমি গাই আপনাকে—মানুষের সম্রাটকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার গুরু গাইতেন কেবল তাঁর জন্য—সম্রাটেরও সম্রাট, সৃষ্টির চূড়ান্ত প্রভুর উদ্দেশে। এইখানেই সেই পার্থক্য।”এই গল্পটি আমাদের শেখায়—সত্যিকারের গুরু নিজের গৌরবের জন্য শিক্ষা দেন না, দেন কেবল মহত্তমের উদ্দেশে। এই শিক্ষক দিবসে, আসুন আমরা সেই গুরু-আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই—যিনি আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে দিতে নিজেকে উজাড় করে দেন। গুরু-শিষ্য পরম্পরা হলো একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে এক গভীর আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক বন্ধন গড়ে ওঠে এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়, যা শিক্ষক দিবসের মূল বার্তা—সম্মান ও সামগ্রিক শিক্ষার—অনুপ্রেরণা।