লাঠিতে ভর দিয়ে ভোট বাঁচাতে লড়াই! কমিশনের শুনানিতে অসুস্থ–প্রবীণদের দুর্ভোগে প্রশ্নের মুখে নির্বাচন প্রক্রিয়া...

নিজস্ব সংবাদদাতা : প্রথমে মস্তিষ্কে স্ট্রোক, তার পরে হার্ট অ্যাটাক—তবু ভোটার শুনানিতে হাজিরা দিতে হল লাঠিতে ভর দেওয়া বৃদ্ধাকে। নির্বাচন কমিশনের নথি যাচাই ও শুনানি প্রক্রিয়া ঘিরে অসুস্থ ও প্রবীণ ভোটারদের দুর্ভোগের ছবি দ্বিতীয় দিনেও সামনে এল হুগলিতে। রবিবার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার)-এর দফতরে খোলা শুনানিকেন্দ্রে দেখা গেল একের পর এক বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে। রবিবারের সেই ছবির কেন্দ্রে ছিলেন প্রবীণ গৌরী মান্না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ গৌরীদেবী লাঠি ছাড়া এক পাও হাঁটতে পারেন না। পরিবারের দাবি, অতীতে তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল, পরে হার্ট অ্যাটাকও। ইনহেলার ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারেন না তিনি। অধিকাংশ সময় শয্যাশায়ী থাকলেও রবিবার নথি যাচাইয়ের জন্য তাঁকে টোটোয় চাপিয়ে এনে হাজির করা হয় শুনানিকেন্দ্রে। ছেলে প্রসেনজিৎ মান্নার সঙ্গে কোনও রকমে পৌঁছন দফতরের সামনে। শুনানিকক্ষ ছিল ভবনের উপরের তলায়। সিঁড়ি ভাঙার ক্ষমতা না থাকায় একতলাতেই বসে অপেক্ষা করতে হয় গৌরী মান্নাকে। অপেক্ষার কষ্ট স্পষ্ট তাঁর মুখে। তিনি বলেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে বসে থাকতে।” পরে কমিশন নিযুক্ত আধিকারিকেরা নীচে নেমে তাঁর শুনানি নিলেও প্রশ্ন উঠছে—এমন শারীরিক অবস্থার মানুষকে কেন এ ভাবে ডেকে আনা হল? একই ছবি দেখা যায় ৮০ বছর বয়সি সুষেনকুমার রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। অতীতে পা ও কোমর ভেঙেছে তাঁর, হৃদযন্ত্রে সমস্যা থাকায় বুকে বসানো হয়েছে পেসমেকার। চোখে গ্লুকোমা, কানেও কম শোনেন। তবু তাঁকেও লাঠিতে ভর দিয়েই পৌঁছতে হয় শুনানিকেন্দ্রে। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে গিয়ে হাঁফ ধরে যায় তাঁর। আধিকারিকদের অনুরোধে পরে তাঁর শুনানি আগে নেওয়া হয়। এই পরিস্থিতি ঘিরে তীব্র রাজনৈতিক তরজাও শুরু হয়েছে।

 হুগলিতে শুনানিকেন্দ্রের বাইরে বৃদ্ধা।

তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছে, নির্বাচন কমিশনের এই শুনানি প্রক্রিয়া কার্যত রাজ্যবাসীর জন্য “শাস্তিমূলক” হয়ে উঠেছে। রবিবার সকালে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে তৃণমূল জানায়, বয়স্ক, অসুস্থ এমনকি শয্যাশায়ীদেরও লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। দলটির দাবি, হুইলচেয়ারে করে প্রবীণদের শুনানিতে হাজির করানো এক ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুরতা।শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনকে সরাসরি “অমানবিক” বলে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রশ্ন, “এটা কি হিয়ারিং? অসুস্থ মানুষদের টেনে তুলে আনতে হচ্ছে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, এটি বিজেপির এজেন্ডা অনুযায়ী পরিচালিত নির্বাচন প্রক্রিয়া, যেখানে বাঙালিদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভোটারদের হয়রানির অভিযোগে হাওড়ার ডোমজুড়েও রবিবার মিছিল করে তৃণমূল। মিছিলের নেতৃত্ব দেন বিধায়ক কল্যাণ ঘোষ। এর আগের দিনও তিনি কমিশন নিযুক্ত আধিকারিকদের সঙ্গে তর্কে জড়ান, কেন বয়স্ক ভোটারদের তিনতলায় শুনানিকক্ষে যেতে হচ্ছে তা নিয়ে। পরে একতলায় শুনানির সিদ্ধান্ত হলেও ক্ষোভ কমেনি। এ দিকে নদিয়ার রানাঘাটে সামনে এসেছে আর এক মানবিক সমস্যা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জেরে নথিগত জটিলতায় পড়েছেন ২৮ বছরের তরুণী মানু মিত্র। জন্ম শংসাপত্রে এক বাবার নাম, আধার ও ভোটার কার্ডে অন্য বাবার নাম—এই বৈপরীত্যে শুনানিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাঁকে। নিয়মের বেড়াজালে পড়ে কী ভাবে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ছেন, তারই আর এক উদাহরণ মানুর ঘটনা।