"সূর্যমুখী মা "

--সিরাজুল ইসলাম ঢালী

চতুর্দিক থেকে ফোন আসছে । সকাল ছটা থেকে রাত নটা । নিত‍্যদিনের ঘটনা ! ফোন সামলানোই অবাক কান্ড ! যা ভাবা যায় না ! বুঝলেন কিছু ? ভক্তের বোঝা ভগবান বয়ে নিয়ে যান, কথাটা সর্বাংশে সত‍্য । অস্বীকার করার পথ নেই । রাত নটার পরেও ফোনের শেষ নেই, তখন শুরু হয় মেয়েদের ও অন‍্যান‍্য আত্মীয় স্বজনদের ফোন । তবু বিরক্তি বোধ করেন না শ্রীমতী সূর্যমুখী উপাধ‍্যায় । উল্টে প্রত‍্যেকটা ফোন তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে সামলান । ফোন সামলাতে কোন সহযোদ্ধার সহযোগিতা কোন দিন নেন নি । তিনি একাই একশো । সেদিন শনিবার হবে, তখন রাত সাড়ে নটা বাজে, সবেমাত্র তিনি কলকাতা টিভির পর্দায় নিউজটা দেখতে শুরু করেছেন, হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল,
... হ‍্যাঁলো...।
... মা, শুনতে পারছো ?
... হ‍্যাঁ, শুনতে পারছি । বল্ ।
... হ‍্যাঁ, আমি সোনালী বলছি । বলছি, আমরা সপরিবারে আগামী মাসের দু'তারিখ নিউইয়র্ক থেকে ফ্লাইটে উঠছি । প্লেনের টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে । তোমার জামাই নাতি নাতনীরা আনন্দে পাগল হয়ে উঠছে। বুঝতে পারছো মা ? ফোনটা করছিলেন ছোট মেয়ে সোনালী । সোনালী ভট্টাচার্য । সফট্ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার । ছোট জামাই হার্ডওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ।
... বুঝতে পারছি । বলছি, সাবধানে আসবি । প্লেনের কথা শুনলে, আমার বুক ধড়ফড়্ করতে শুরু করে । বুঝলি সোনালী ?
... মা, শুধু শুধু চিন্তা করবে না । আমরা সাবধানেই যাবো । হবে তো ? খুশী ? ফোন রাখছি, আর না এখন, তুমি রেষ্ট্ নাও । রাত হচ্ছে । রাখছি কিন্তু....। বাই ! গুড্ নাইট্ ।
... হ‍্যাঁ, গুড্ নাইট্ ।
ফোনটা রাখতে যাচ্ছিলেন, রাখা হল না । আবার ফোন ! বড় মেয়ের ফোন বলে কথা । ধরতেই হল । কথাবার্তা চললো বিশ মিনিট মত, হাজার কথাবার্তা, কথার যেন শেষ নেই ! বড় মেয়ে রূপালী আচার্য । নেপালের কাঠমান্ডুতে থাকেন । বড় মেয়ে ও জামাই যথাক্রমে ব‍্যাঙ্ক মানেজার ও কলেজের উপাচার্য ।
সেদিন দেখতে দেখতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল । রাত তো হবেই, রাত হবে বলে কি আর ফোন আসবে না ? সত‍্যি বলতে, আবার ফোন, ফোন ধরতেই তিনি বুঝতে পারলেন, মেজ মেয়ের ফোন । মেজ মেয়ে আর মায়ের ফোন, শেষই হয় না । হওয়ার কথাও না ! কি মুশকিল ! অবশেষে বলি, মেজ মেয়ে কিন্তু কোন অংশে কম নন, সাক্ষাৎ লক্ষী, 'রাঙ্গাজবা আলতা ও সিঁন্দুর' কোম্পানির ঘরের একমাত্র মালিকের বউ । অঢেল টাকা পয়সা ! অর্থের শেষ নেই । মেজ জামাই এক্কেবারে বাবা গণেশ, শ্রীমান পীতাম্বর চ‍্যাটার্জী । হাওড়ার বাসিন্দা ।
না, এবার দেখছি অনেক রাত হয়ে গেল । দূর থেকে ভেসে আসা লক্ষী পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে । সূর্যমুখী উপাধ‍্যায়ের অন‍্যান‍্য দিনের মত আজও ঘুম হবে কি ? হবে বলে মনে হচ্ছে না । স্মৃতি সদা জাগ্রত ! হঠাৎ মনে পড়ল, ছোট মেয়ে যখন দু'বছরের, তখন একদিন রবিবারে স্বামী শ্রী চন্দ্রশেখর উপাধ‍্যায়, পেশায় গৃহ শিক্ষক, রাত্রিবেলায় ডিনার করে স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়েছিলেন, নি:শব্দে হার্ট অ‍্যাটাকে তিনি মৃত‍্যু বরণ করেছিলেন, আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেন নি । সেদিন চোখের জলে সূর্যমুখী উপাধ‍্যায়ের জীবন শুরু হলেও, পরের দিন থেকেই তিনি চোখ মুছে মেয়েদের নিয়ে জীবনে বাজিমাৎ করতে শুরু করেছিলেন । মেজাজ ছিল 'ডু অর্ ডাই' ! অনতিবিলম্বে শুরু করেছিলেন, 'বউদি হোম ডেলিভারি ফুড সেন্টার' । সবার জন্য সস্তায় লাঞ্চ অ‍্যান্ড্ ডিনার । মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করতে করতে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে সূর্যমুখী উপাধ‍্যায় । আর আজ তিনি 'বউদি হোম ডেলিভারি ফুড সেন্টারে'র সুবাদে খ‍্যাতির উচ্চ শিখরে উঠছেন, সন্দেহ নেই । চতুর্দিকে শুধু জয়জয়কার!