এক আদর্শবান ও কর্মনিষ্ঠ মানুষের কথা -মিন্টু চৌধুরী
আজ একটা গল্প বলি শুনুন। না, ঠিক গল্প নয়। সত্য, একেবারে নির্ভেজাল সত্য। এক মানুষের কথা। মানুষের মত মানুষ। নিঃস্বার্থ সমাজসেবী, পরোপকারী, বামপন্থী ভাবাদর্শে অনুপ্রানিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক ও লেখক হয়েও তিনি চিরকাল থেকে গেলেন প্রচারের আড়ালে। সৌম্য,শান্ত, সুভদ্র, জনপ্রিয় এই মানুষটি একটানা পঁচিশ বছর খড়্গপুর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ছিলেন। দীর্ঘ পনের বছর ছিলেন ভাইস-চেয়ারম্যান । বার্ধক্য ও অসুস্থতা তাঁকে কাবু করতে পারে নি। আজও তিনি সেবামূলক, সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিশীল কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি স্বনামধন্য রঞ্জিত গোস্বামীর কথাই বলছি।সালটা ছিল ১৯৪৩ । ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের আচমিতা গ্ৰামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাম্হণ পরিবারে রঞ্জিত গোস্বামীর জন্ম। পিতা ৺দীনেশ চন্দ্র গোস্বামী এবং মাতা মানদাসুন্দরী দেবী। ওনারা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন পরিবারের সুখভোগ কিন্ত রঞ্জিত গোস্বামীর কপালে বেশি দিন জোটেনি। দেশভাগের মর্মান্তিক পরিস্হিতির শিকার হলেন তাঁরা। বড় দাদা প্রফুল্ল চন্দ্র গোস্বামী ও মেজদা বাণেশ গোস্বামীর হাত ধরে চৌদ্দ পুরুষের বিশাল সম্পত্তি ছেড়ে এই বঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হন তাঁরা। অসহায় ভাগ্যবিড়ম্বিত পরিবারের আশ্রয় জোটে খড়্গপুরের ভবানীপুর অঞ্চলে, উদ্বাস্তু-নেতা ননী ঘোষের ব্যারাকে।
শুরু হয় অভাব ও দারিদ্রের সাথে কঠিন-কঠোর নিরন্তর সংগ্ৰাম। বড় দাদা ভাইবোনদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ও যত্নবান ছিলেন। রঞ্জিত গোস্বামীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় সুভাষ পল্লীর মাদ্রাসা স্কুলে। পরবর্তী শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয় অতুলমনি হাইস্কুল, খড়্গপুর ও মেদিনীপুর কলেজে। কৃতিত্বের সাথে বি.এ.বি.এড.পাশ করার পর তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।তিনি ছিলেন মালঞ্চের আর্য বিদ্যাপীঠ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঐ বিদ্যালয়েই মাত্র তিরিশ টাকা মাসিক মাহিনায় সহকারী শিক্ষক রূপে যোগ দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র শিক্ষকতার বৃত্তে তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। লোকপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। বহুবার তিনি কমিশনার পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। খড়্গপুর মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান রূপে তাঁর কর্মধারা উচ্চ প্রসংশার দাবী রাখে। পরবর্তী কালে তাঁর ওয়ার্ডটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলে ঐ ওয়ার্ড থেকে তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিনী শ্রীমতী অলকা গোস্বামী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্বামীর কার্যধারা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রয়াসী হন। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয়, ২০১১ সালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রীমতী গোস্বামীর জীবনাবসান ঘটে। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা শ্রী গোস্বামীকে দুঃসহ দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে। কিন্তু সেবা ও সৃষ্টির প্রেরণা যাঁর শিরা-উপশিরায়, তিনি তো শোকের ঘেরাটোপে বন্দী থাকতে পারেন না। আবার তিনি ফিরে এলেন মানবসেবা ও সৃষ্টিশীল কর্মের আঙিনায়। পরবর্তী কালে ঘৃণ্য রাজনৈতিক আবহের প্রেক্ষাপটে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। এই ঘটনা তাঁর মত আদর্শ বাদী মানুষকে এতটাই মর্মাহত করে যে, তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এবং অরাজনৈতিক সেবামূলক কার্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেন। তিনি এলাকার বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত। গিরি ময়দান রেল স্টেশনের পাশে তাঁরই উদ্যোগে বয়স্ক মানুষদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন নানা সেবামূলক কার্যে অংশগ্ৰহণ করে। মহাপুরুষদের জন্মজয়ন্তী ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি ও এই সংগঠনের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। শ্রী গোস্বামী বর্তমানে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে কার্যরত। লেখক হিসেবেও শ্রী গোস্বামী কৃতিত্বের অধিকারী। ভ্রমণ-সাহিত্যের ওপর ইতিমধ্যেই তাঁর তিনটি গ্ৰন্হ প্রকাশিত হয়েছে।এই কর্মোদ্যোগী ও আদর্শবান মানুষটির আগামী জীবন হোক সুন্দরতর। তিনি সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন, নব নব সৃষ্টির আনন্দে থাকুন মাতোয়ারা। তাঁর প্রতি রইল আমাদের হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।