বাংলাদেশে কালোটাকা বৈধ করার পথ বন্ধ হচ্ছে, বাতিল হল মুজিব পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন!

ঢাকা, জাকির হোসেন: বহুল সমালোচিত কালোটাকা সাদা তথা বৈধ করার বিধান বাতিল হচ্ছে বাংলাদেশে৷ এই বিধান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে এই তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রকের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। যমুনার গেটে প্রেস ব্রিফিংয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, "বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কালো টাকা সাদা করার যে বিধি ও রীতি তা বন্ধ করে দেওয়া। এটা থেকে সরকার যেটুকু টাকা আনতে পারে, সেই টাকা দিয়ে সরকারের খুব এগোয় না, তবে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়। এটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।" ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা তথা বৈধ করার সুযোগ দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের সময়ে গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ‘নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২৪’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয় ও জুলাইয়ে অনুমোদিত হয়৷ তৎকালীন সরকারের এ সিদ্ধান্ত তখন তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। কারণ, বৈধ করদাতাদেরকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আয়করের পাশাপাশি অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হয়৷ অপ্রদর্শিত আয়ের ছদ্মবেশে কালো টাকা সাদা করার এই ‘অনৈতিক’ বিধান নিয়ে বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতিবিরোধী এ প্রতিষ্ঠান আশঙ্কা করেছিল, "মাত্র ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার সুবিধা নিরুৎসাহিত করবে সৎ ও বৈধ করদাতাদের। কারণ এই বিধানের অধীনে ঘোষিত অর্থ ও সম্পদ নিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। ১৫ শতাংশ করের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অনুমতি আর্থিক খাতের অনিয়মকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।" বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও (এফবিসিসিআই) কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছিল। অবশেষে, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলে অর্থনীতিতে কালোটাকা বৈধ করার পথ বন্ধ হল অন্তবর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্তে। শীঘ্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরেও ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বৈধকরণের সুযোগ দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হতে জানা গেছে, ওই বছর মোট ১১ হাজার ৮৩৯ জন প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছিল, যা এক বছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ওইসব বিনিয়োগ থেকে দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছিল এনবিআর। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খোদ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই উঠেছে দেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় অভিযোগ৷ এছাড়াও হাসিনা-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে নজিরবিহীনভাবে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা৷ যার ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো গণহারে দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়েছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে গিয়েছিল একদম শূন্যের কোঠায়৷ শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে ব্রিটিশ সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিক সহ শেখ হাসিনা-রেহানার পরিবারের প্রায় সব সদস্যের বিরুদ্ধেই উঠেছে অর্থ পাচারের বিস্তর অভিযোগ৷ এগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে৷

২৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক

এদিকে, 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯' সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই আইন সংশোধনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধা আর থাকছে না। সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের 'প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে 'বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪'-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত আইনে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার বিধান বাতিল করে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন সংশোধন করার প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়, বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯' প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছিল। কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য আইনটি করা হয়েছিল যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সকল বৈষম্য দূর করতে দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছে। সংসদ কার্যকর না থাকায় এই আইনটি রহিত করতে অধ্যাদেশ জারি করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে, উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠক কর্তৃক 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪'-এর খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়৷ অন্যদিকে ''বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১' সংশোধনের ব্যাপারে বলা হয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এর আওতায় প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনের আওতায় 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিবারের সদস্যগণের' নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত বিধানসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাই এই আইনের কতিপয় বিধান বিলোপসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সংযোজনপূর্বক 'বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪' উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়।