"চাকা" --শ্রীমন্তী ভাণ্ডারী
রেবেকার আজ শরীর ভাল নেই।
কেমন জ্বর জ্বর ভাব। মাথা ভার।
ইচ্ছে করে তার ছোট্ট এক কামরা টালির চালের ঘরে মায়ের সাথে আজ বিশ্রাম নেবে।
তার প্রিয় দড়ির খাটিয়ায় একসঙ্গে বসে দুজনে আদা চা আর চপ মুড়ি নিয়ে জমিয়ে গল্প করবে , অফুরন্ত আড্ডা মারবে।
রেবেকার আঠারো বছরের জীবনের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে , রোজকার জীবন সংগ্রামে এইটুকুই বিরাট বিলাসিতা , বিরাট পাওয়া।
রেবেকার সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত একনাগাড়ে ছোটা। মাঝে দুপুরবেলা শুধু একবার খেতে আসা। একঘণ্টার বিরতি। তারপর আবার ছোটা। রেবেকার জীবনের, পেশার চাকা চলতে থাকে। ছুটতে থাকে। রেবেকা পেশায় রিক্সা চালক। রিক্সাই তার আয়ের , উপায়ের বিশ্বস্ত নির্ভরস্থল, বিশ্বস্ত বন্ধু। রিক্সার চাকায় তার আঠেরোর জীবন , যৌবন জড়িয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সদ্য যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের তথাকথিত , গতানুগতিক , সহজ,স্বাভাবিক, পরিচিত, চিরন্তন অনুভূতি। লালফিতে,জরিচুমকির শাড়ি, কাঁচের চুড়ির বদলে রেবেকার দুটো শক্ত , শিরা ওঠা হাত আর শক্ত মন সকাল , সন্ধ্যে লড়াই করে। দু মুঠো গরম ভাতের জন্য, বৃদ্ধা , অসুস্থ মায়ের দেখাশোনার জন্য।
রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, ঠাণ্ডার কামড়ে সয়ে যাওয়া লড়াকু রেবেকা।
সে হারতে চায়না, সে হারতে জানেনা, সে হারতে শেখেনি।
সন্ধ্যের সাঁঝ প্রদীপ যখন জ্বলে ওঠে ঘরে ঘরে , বোকা বাক্সের সিরিয়ালের জমাটি নাটকে বুঁদ হয়ে থাকে তাদের বস্তির সমস্ত মানুষ, তখন রেবেকার জীবনের আর এক অধ্যায় শুরু।
রাতের রান্না চটপট সেরে ছোটে বস্তির লাগোয়া রেলস্টেশনে।
ছোট্ট উনানের আঁচে পুড়তে থাকে নরম , কচি ভুট্টা। হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছোট, বড় অনেকেই। রাত নটার বনগাঁ লোকাল বাঁশী বাজিয়ে রেলস্টেশন ছেড়ে চলে যায়।
ভিড় তখন অনেক হাল্কা। রেবেকা তার তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ঘর মুখো। টালির চালের এককামরার পায়রার খোপে মা ও মেয়ের সংসার।
ঘরের পাশে অজান্তে বেড়ে ওঠা কলকে গাছটা অজস্র হলুদ ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে।
তার ঝির ঝিরে হাওয়া হাসিমুখে,
মাথা নাড়িয়ে পরম আদরে রেবেকাকে যেন তার জীর্ণ কুটিরে সাদরে অভ্যর্থনা করে।
তারই পাশে বেড়ে ওঠা পুঁই গাছের পাতা গুলো চাঁদের নরম আলোয় চিকচিক করে।তা বড় মিষ্টি লাগে রেবেকার। সারাদিনের দেহ ও মনের ক্লান্তি যেন নিমেষে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। রেবেকার এই সময় টুকু নিজের। পরিচিত ঘরের কোণ টুকু বড় আরামের লাগে।
গা হাত পা ধুয়ে , রাতের খাবার খেয়ে খাটিয়ায় বসে পা ঝুলিয়ে
মায়ের সাথে গল্প জোড়ে।
সারাদিনের অজস্র ঘটনা।
অম্ল, মধুর , তিক্ত।
আস্তে আস্তে রাত গভীর হয়।
ঘুম পরীরা ডানা ঝাপটায়।
রেবেকার ক্লান্ত চোখ দুটোতে ঘুম জড়িয়ে আসে। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপের পর শুধু রাতটুকুই
শান্তিতে ঘুমানোর। ঘুমন্ত রেবেকা এখন স্বপ্নে বিভোর।
তাদের টালির নড়বড়ে ভাড়া ঘরের চালের বদলে নিজে হাতে গড়া এক কামরা ঘরের পাকা ছাদ। অসুস্থ মায়ের সুস্থ হাসি মুখ।
আবার একটা সূর্য ওঠা সকাল।
আবার নতুন করে লড়াইয়ের শক্তি ।