বারাণসীর মদনপুরা বাঙালিটোলায় মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা মন্দিরে রহস্য!

নিজস্ব সংবাদদাতা:  পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বেঁচে থাকা শহর বারাণসী। সালটা ১৭৬৭।খড়, মাটি, বাঁশের কাঠামো দিয়ে একেবারে বাংলার মতো দুর্গা মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেছিলেন কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। বারাণসীর সংস্কৃতির খানিকটা প্রভাব পড়লেও নতুন প্রজন্মের মধ্যেও বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি সেখানে আজও অটুট। আশ্বিনের শারদ প্রাতে বারাণসী শহর যখন নবরাত্রির আনন্দে মেতে ওঠে, তখন বাঙালি টোলা ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুর্গাপুজোর জোগাড় করতে।১৭৬৭ সালে শারদীয়া নবরাত্রির ষষ্ঠীর দিন নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে নিয়ম-আচার মেনে মা দুর্গার পুজো করা হয়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে দশমীর দিন। সনাতনী নিয়ম অনুযায়ী, দশমী বা দশেরার দিন দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়। কলকাতা থেকে কাশী সব জায়গাতে একই নিয়ম। বাপের বাড়িতে কটা দিন আনন্দে কাটিয়ে কৈলাসে ফেরে উমা। মাকে বরণ করে মহাসমারোহে তিথি মেনে বিসর্জনের পর্ব চলে। শুধুমাত্র মুখোপাধ্যায় পরিবারের ঠাকুর বিসর্জন দেওয়া হয় না। বরং স্পষ্ট করে বলা ভলো, কোনও এক রহস্যময় কারণে দেবীর মূর্তি বিসর্জন দেওয়া যায় না।

তাই আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে মাটির দুর্গা মূর্তি পুজো হয়ে আসছে।মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তি বিসর্জন দেওয়া যায়নি। যেখানে মূর্তি বসানো হয়েছিল কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেখান থেকে মূর্তিকে এক চুলও নড়ানো যায়নি। শোনা যায়, প্রতিমা তোলার চেষ্টা করলে তা অস্বভাবিক ভারী বলে মনে হয়। বেশ কয়েকজন মিলেও প্রতিমাকে ওই স্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরাতে পারেননি। সেই রাতেই দেবী কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়কে স্বপ্নে দেখা দেন। দেবী নির্দেশ দেন, যে তাঁকে যেন বাস্তুচ্যুত না করা হয়। কাশীবাসীর কল্যাণের জন্য তিনি এখানেই থেকে যেতে চান। একবার নয়, একাধিক বছর মায়ের বিসর্জনের চেষ্টা করা হলেও প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন সকলে। আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মাটির মূর্তি পূজিত হচ্ছে। আর সেই থেকে এই মন্দির এখানে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়রা একে বলেন, পুরনো দুর্গা বাড়ি। মায়ের পুজোপ্রতি বছরই পুজো এলে নতুন করে শাড়ি-গয়নায় সেজে ওঠেন উমা। আচার মেনে হয় পুজো।

আর প্রতি পাঁচ-ছয় বছর অন্তর মায়ের প্রতিমায় নতুন করে পড়ে রঙের প্রলেপ। প্রতি বছর প্রাচীন কাঠামোর উপরেই মূর্তি সংস্কার করে নেওয়া হয়। এই কাজের দায়িত্বে থাকেন মূলত পাটনার কারিগরেরা। প্রসাদ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করা হয় ছোলা এবং গুড়। অবাক লাগলেও অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিমায় থাকা খড়, কাদা, বাঁশ, সুতো কোনও কিছুই নষ্ট হয়নি! এই শহরের সকল মানুষ জানেন, পুরাতন দুর্গা বাটির মা উমাকে ঘিরে এমন ইতিহাস। ওই পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, পুজোর সময় কেবল নতুন গয়না ও শাড়িতেই সেজে ওঠেন দেবী। ৫-৬ বছর পর মূর্তিতে শুধু রঙের প্রলেপ পড়ে এই যা।বর্তমানে ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সোনালি মুখোপাধ্যায় পুজো নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ওই ঠাকুরদালানে থাকা একটি বড় নোটিশ বোর্ডের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেন। সেই বোর্ডেই এই পুজোর কিছুটা ইতিহাস রয়েছে। দেবী দুর্গা ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তাকে স্বপ্নে বলেছিলেন, তাকে যেন ছোলা-গুড় দিয়েই পূজো দেওয়া হয়। ফলে পুজোতে ছোলা-গুড় থাকবেই।মায়ের বর্তমান সেবাইত রীনা পাল বলেন, “হুগলির জনাই রোডের এই পুজো বারাণসীতে যখন ১৭৬৭ সালে প্রথম শুরু হয়। সেই বছর দশমীতে মাকে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু এক ইঞ্চিও সরানো যায়নি এই মাতৃপ্রতিমা। মা স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, তিনি কাশীতেই থাকতে চান। এরপর থেকেই চিরস্থায়ী হয়েছে মায়ের কাশীবাস।