"এ জীবন ল‌ইয়া কী করিতে হয়"

মৃদুল শ্রীমানী: শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন মানুষের জীবনের লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। তিনি নিজে কি ঈশ্বরলাভ করেছিলেন? মনে হয় না। তাঁর ঈশ্বরলাভ হয়ে গিয়েছে, এমন প্রতীতি হলে ক‍্যানসার আক্রান্ত স্বামীর আরোগ্য চেয়ে সহধর্মিণী সারদামণি তারকেশ্বরে গিয়ে হত‍্যে দিতে যেতেন না, নিশ্চিত। শ্রীরামকৃষ্ণও বাঁচতে চাইছিলেন। গলার কষ্টে ক‍্যানসার রোগী ঢোঁক গিলতে পারতেন না। অথচ ক্ষুধাবোধ রয়েছে। পুষ্টিকর খাদ‍্যের প্রয়োজন বুঝতে পারেন। ডিম আনা হত। কোনো কোনো দিন চটকে চটকে একটু গিলতে পারতেন। কোনোদিন কশ বেয়ে পড়ে যেত। গেঁড়ি গুগলির পাতলা ঝোল চেয়েছিলেন সারদামণির কাছে। শুনেছিলেন ওতে ভারি পুষ্টি। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা সংসারে ওই দিয়ে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করবেন। সারদামণি নারাজ। ছোট ছোট জীব, চলে ফিরে বেড়ায়, ওদের আমি ছেঁচতে পারব না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, হ‍্যাঁ গা, আমার জন‍্যেও পারবে না? অথচ সিমলে পাড়ার নরেন দত্তকে বলে দিলেন, ঈশ্বরকে দেখেছি কি রে, তোকে যেমন দেখছি, তার থেকেও স্পষ্ট করে দেখেছি।বিবেকানন্দ হয়ে নরেন্দ্রনাথ দত্ত অবশ‍্য ভিন্ন ধরনের কথা বললেন।

বললেন, মানুষের ভিতরে প্রথম থেকেই পূর্ণতা বিদ‍্যমান। বললেন, এডুকেশন ইজ় দি ম‍্যানিফেস্টেশন অফ দি পারফেকশন অলরেডি ইন ম‍্যান। গুরুর সামনে বলতে ভালবাসতেন, সোহহং, আমিই সেই। গুরু একটু সংশোধন করে দিতে চেয়ে একটা দা লাগিয়ে বলতেন, দাসোহহং। আমি তোমার দাস। শ্রীরামকৃষ্ণ নাকি চিৎকার করে বলতেন, ওরে ভক্তেরা কে কোথায় আছিস, আয়। যারা আসতেন, তারা সংসারী মানুষ। বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে বড় রাগ করতেন সাধুটি। আর ছেলেপুলে হয়ে গেছে শুনলে বলতেন, ছ‍্যাঃ!একজন এসেছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত  (১৪ জুলাই ১৮৫৪ - ৪ জুন ১৯৩২)। 'শ্রীম' নামে সমধিক পরিচিত। পেশা শিক্ষকতা। লোকজন তাঁকে বলত মাস্টার মহাশয়। পড়াশুনা প্রেসিডেন্সি কলেজে। তার আগে হেয়ার স্কুলে। একসময় রিপন কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন। এই মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে বিয়ে হয়ে গেছে ও বাচ্চা আছে জেনে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সাধুটি। এই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সাধুর ঘরে বসে বসে সবকিছু শুনতেন। পরে বাড়িতে ফিরে ডায়েরিতে সব লিখে রাখতেন। প্রথমে ব‌ই আকারে বের করার কোনো ভাবনাই ছিল না মহেন্দ্রের। ১৯০২ তে চলে গেলেন বিবেকানন্দ। ওই ১৯০২ তে প্রথম খণ্ড বেরোলো শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। তারপর ক্রমে ক্রমে ১৯০৪, ১৯০৮, ১৯১০ ও শেষ খণ্ডটি ১৯৩২এ । ততদিনে জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছে শ্রীম-র। ওই ১৯৩২ এই সাতাত্তর বছর বয়সে দেহরক্ষা করলেন। এর দশটা বছর পরে ১৯৪২-এ স্বামী নিখিলানন্দ (১৮৯৫ - ১৯৭৩) এই মহাগ্রন্থের ইংরেজি ভাষান্তর প্রকাশ করেছেন। মূল গ্রন্থের ভাষাকে পাশ্চাত্যের পাঠকের রুচির অনুসারী করে নিয়েছিলেন তিনি। তার বছর চৌদ্দ আগে, ১৯২৮-এ নোবেলজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক দার্শনিক রোম‍্যাঁ রোল‍্যাঁ (১৮৬৬ - ১৯৪৪) লিখলেন দি লাইফ অফ শ্রীরামকৃষ্ণ।এ জীবন কেন, কিসের জন্য, এ ভাবনা ভাবিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। গীতাঞ্জলিতে লিখেছেন, আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে। ওই কথাটাই বারে বারে বলবেন। নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতায় বলবেন আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী, তার আগে সোনারতরী কবিতায় আর্ত স্বরে বলবেন, যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। বারে বারে কবির সঙ্গে দেখা হয় এক ছলনাময়ীর।  একেবারে শেষ পর্যায়ের লেখায় বলবেন, যে পেরেছে অনায়াসে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে অক্ষয় শান্তির অধিকার। 

জীবনানন্দ দাশের কাছে জীবন কিভাবে দেখা দিল লক্ষ্য করতে গিয়ে "সুচেতনা" কবিতা আমাকে হাতছানি দেয়। মাটি পৃথিবীর টানে কখন এসেছি, না এলেই ভাল হত অনুভব করে। আর ১৯৪৬-৪৭। ওই কবিতায় বললেন, পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হয়ে গেছে জেনে, তবু/ আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে/ পরিচিত জল, আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার করে নিতে হবে/ ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হয়ে যায়।এই যেন মৃত্যু, এরপর কী বলেন জীবনানন্দ? "মৃতেরা কোথাও নেই, আছে? / কোনো কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়।"আর কী মনে হয় জীবনানন্দের? "সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় --দ্বেষ/ সৃষ্টির মনের কথা: আমাদেরি আন্তরিকতাতে/ আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব‍্যথা খুঁজে আনা"বলেন, এ যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে/ এ যুগে কোথাও কোনো আলো --কোনো কান্তিময় আলো / চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের।সাধারণ মানুষের জীবন যাপন কীভাবে হবে? ঈশ্বর, না কি রোটি কাপড়া ঔর মকান? নরেন্দ্র তাঁর গুরুকে জিজ্ঞাসা করছেন বিশ্বনাথ দত্তের ফেলে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের গ্রাসাচ্ছাদন চলবে কি করে? গুরু পরামর্শ দিলেন ভবতারিণী নামে যে কালি প্রতিমা, তার কাছে চেয়ে নিতে। নরেন্দ্র তা চাইতে পারলেন না। সুপুরুষ সুস্থ বুদ্ধির যুবক অমনটা পারবেন কি করে। তিনি চাইলেন জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য। আর যৌবনোদ্ধত বাঙালি চাইল ইংরেজের শাসন থেকে মুক্তি। বিপ্লবীদের প্রায় প্রত‍্যেকের ঘরে ব‌ইয়ের ভিতরে একটাই লোকের ছবি লক্ষ্য করেন টেগার্ট। পুলিশের বড়থাকের অফিসার। তা হলে এই লোকটাই সবাইকে ভুল বোঝায়! এই ভেবে টেগার্ট বললেন ছবির লোকটাকে ধরতে। ততদিনে বিবেকানন্দ অনেকদিন মৃত। 

বিপ্লবীরা কি চাইলেন? সুভাষচন্দ্র বসু কী চাইলেন? কলকাতার মেয়র হলেন ভোটে জিতে। বছর গড়াল না, সরে যেতে হল বাঙালির কাঠিবাজিতে। কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। ভোটে জিতে। কিন্তু টিঁকতে পারলেন না স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধতায়। কংগ্রেস ছাড়লেন। বেরিয়ে এসে গড়লেন ফরোয়ার্ড ব্লক। সে দল সর্বভারতীয় চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু অল্পদিনের মধ‍্যেই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন সুভাষ। শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, আদ‍্যন্ত দক্ষিণপন্থী সুভাষ। কিন্তু সুভাষ প্রথমে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সম্মত হলেন না। ভারতের শ্রমিকের মুক্তিযুদ্ধের চাইতেও নিজেদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সুরক্ষা তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারপর অরল‍্যাণ্ডো ম‍্যাজোত্তা গেলেন জার্মানি। সেখানেও বিফলমনোরথ হয়ে শেষ পর্যন্ত জাপানে।দেশ স্বাধীন হল, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ সুভাষকে পেল না। পেল রহস্য। পেল বিমান দুর্ঘটনার গল্প। সাধু হয়ে যাওয়ার গল্প। কেউ বলল, রাশিয়ার লোকজন সুভাষকে সাইবেরিয়ার কারাগারে রেখে মেরেছে। রাশিয়া অদ্ভুত ভূমিকা নিল। কী চাইল রাশিয়া? রাশিয়ায় শিল্পোন্নতি হোক, আর ইউক্রেন থাক চাষবাস নিয়ে।

ইউক্রেনে শিল্পের বিকাশ ঘটে কী লাভ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিলেন রাশিয়ায় তীর্থদর্শনে এসেছেন। তলিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখলেন অন‍্য কিছু দেখছেন। একটা ছাঁচ দেখছেন। সেই ছাঁচ ফেটে চুরমার হয়ে গেল গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার পথে। মিখাইল গরবাচভের দেওয়া উপহার। গরবাচভের নোবেল পুরস্কার জুটল। সাড়ে তিন দশক হতে গেল টুকরোগুলো আর জোড়া লাগল না। যুদ্ধের ময়দানে মরতে লাগল লেনিনের স্বপ্ন।মানবেন্দ্রনাথ রায় বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লেনিন নেন নি। সেভাবে মান‍্যতাও দেননি। মানবেন্দ্র দেশে ফিরে জেল খাটলেন। বারো বছরের মেয়াদ শেষ হল ছয় বছরে। কিন্তু তাতেই ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল তাঁকে। তারপর মানবেন্দ্র র‍্যাডিক‍্যাল হিউম‍্যানিস্ট হলেন। আরো পরে নবমানবতাবাদ। পথের দাবির সব‍্যসাচী অপূর্ব ভারতীর প্রেমকে রক্ষা করতে ব্রজেন্দ্রর নিষ্ঠুর হাত থেকে বাঁচাতে সক্রিয় র‌ইল।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথের দাবিকে বললেন সিডিশাস। বললেন এ ব‌ই লোকজনকে খেপিয়ে তুলবে‌। লেখক বললেন, আমি তো সেটাই চেয়েছি। লোকজন খেপে উঠুক‌ ওই তো আমার কাঙ্ক্ষিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন্দিনীকে নামালেন লড়াইয়ে‌ সে লড়াই গান গেয়ে নয়, হাতে অস্ত্রের দরকার পড়ল। কিন্তু চৌরিচৌরায় হিংসা দেখা দিয়েছে অজুহাতে সারাদেশে আন্দোলন থামিয়ে দিলেন গান্ধিজি।"বিভিন্ন কোরাস" কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন "আমরা তো বহুদিন লক্ষ্য চেয়ে নগরীর পথে/ হেঁটে গেছি ; কাজ করে চলে গেছি অর্থভোগ করে/ ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে। ... তবুও কোথাও কোনো প্রীতি নেই এতদিন পরে।...বিকেলের বারান্দার থেকে সব জীর্ণ নরনারী/ চেয়ে আছে পড়ন্ত রোদের পারে সূর্যের দিকে..."'তুমি কেন বহু দূরে' কবিতায় লিখলেন, তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু ক্লান্তি/ রক্তের কণিকা ঝরে শুধুলিখলেন, স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ/ স্বপ্ন কি দেখেনি রোম এশিরিয়া উজ্জয়িনী গৌড় বাংলা/ দিল্লী বেবিলন"।আমাদের ভোটের পরে ভোট চলছে। সংসদে আলোচনার সময় কমছে, আলোচনার মান ধূলি ধূসরিত হয়ে গেল।এই কি চেয়েছিলেন কনসটিট‍্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নেতারা? এই কি চেয়েছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ? এই কি আজাদি আমাদের?

মৃদুল শ্রীমানী- ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট