বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস নিয়ে সচেতনতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত!

জয়দেব বেরা : আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস।এই বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস ( WSPD ) হল একটি সচেতনতা দিবস যা প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয়, যা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুতি এবং পদক্ষেপ প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে।আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা (IASP) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন (WFMH)-এর সাথে সহযোগিতা করে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের আয়োজন করে।উইকিপিডিয়ার তথ্য সূত্র মতে,২০১১ সালে আনুমানিক ৪০টি দেশ এই উপলক্ষে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।২০১৪ সালে প্রকাশিত WHO-এর মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাটলাস অনুসারে, কোনও নিম্ন-আয়ের দেশে জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশল থাকার কথা জানানো হয়নি, যেখানে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলির ১০% এরও কম এবং উচ্চ-মধ্যম এবং উচ্চ-আয়ের দেশগুলির প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কাছে ছিল।এই প্রসঙ্গে WHO এর মতামত হল, "যদিও পুরুষদের তুলনায় নারীদের আত্মহত্যার চিন্তা বেশি, তবুও পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি।গড়ে, প্রতি মহিলার জন্য প্রায় তিনজন পুরুষ আত্মহত্যা করে - যদিও এশিয়ার কিছু অংশে, এই অনুপাত অনেক কম(WHO,2002)।আবার IASP এর মতে, "আত্মহত্যার হারের এই বৈষম্য আংশিকভাবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি প্রাণঘাতী উপায় ব্যবহার এবং আত্মহত্যার সময় বেশি আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং মৃত্যুর ইচ্ছার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ( IASP,2012)।"

যাইহোক, আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও সচেতনতা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক,সমাজকর্মী, মনোবিদরা বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন।এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত ড.অনিরুদ্ধ চৌধুরী (সমাজতাত্ত্বিক, প্রবীণ অধ্যাপক এবং লেখক) এর মতে, "2003 সাল থেকে প্রতি বছর 10 সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সমিতি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথ উদ্যোগে এই বিষয়ে সচেতনতা প্রসারে এই দিনটি পালন করে। সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খেইম তাঁর আত্মহত্যা সংক্রান্ত তত্ত্বে আত্মহত্যাকে এক সামাজিক ঘটনা ( social fact) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ব্যক্তির আত্মহত্যার প্রবণতার পেছনে কোনো না কোনো সামাজিক কারণ থাকে। তাই সব আত্মহত্যা একই চরিত্রের হয় না। তিনি পৃথিবীর নানা ধরনের সমাজ থেকে তুলনামূলক তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন যে সমাজ যত বেশি সংহত সেখানে আত্মহত্যার ঘটনা তত কম। মানুষ যত একলা তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তত বেশি। গ্রামের মানুষের সমষ্টি - কেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে সেখানে তুলনামূলক ভাবে আত্মহত্যা কম। শহরের দৈনন্দিন জীবন যাপনে এর অভাব। এখানে মানুষে মানুষে বেঁধে বেঁধে থাকার সুযোগ কম, প্রাথমিক সম্পর্কের অভাব। গৌণ সম্পর্কের প্রাধান্য। তাই সমাজ বিশেষে নানা আর্থ- সামাজিক কারণ anomic suicide যেমন ঘটায় আবার ব্যক্তিগত কারণে egoistic suicide আমরা ঘটতে দেখি। তাই আমার মনে হয় এই দিবস পালনে আমাদের সচেতনতাকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। এলাকার মানুষকে এই কর্মকান্ডে সামিল করতে হবে। তবেই আজকের দিনটি কে সঠিক ভাবে আমরা পালন করতে পারবো।

এই প্রসঙ্গে মৌমিতা গাঙ্গুলি (মনোবিদ,কাউন্সেলর এবং স্পেশাল এডুকেটর) বলেছেন, "WHO এর মতে,বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় 80,0000 এর কাছাকাছি মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যান।মানুষ যখন আত্মহত্যা করেন তখন তার মধ্যে নানান পরিবর্তন লক্ষণীয়।আত্মহত্যার পরিসংখ্যান কমাতে হলে প্রথমে পরিবারকে তার সদস্যদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।আত্মহত্যা সম্পর্কিত কোনও রকম খারাপ বা নেতিবাচক কিছু শুনতে(যেমন: আমি মরে গেলেই হতো,আমি মরে গেলে কারোর কিছু যায় আসেনা,বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই প্রভৃতি) পেলে সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।এছাড়াও মেজাজ ও আচরণগত কিছু পরিবর্তন হলে সেগুলোকেও গুরুত্বের সহিত দেখতে হবে।কোনও সদস্য যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে তখন তাকে শাসন না করে মানসিকভাবে তার পাশে থাকতে হবে।আর তার পাশাপাশি কোনও মনোবিদ ও কাউন্সেলর কাছে নিয়ে যেতে হবে।"

জয়দেব বেরা বলেন "প্রথমে বুঝতে হবে আমাদের জীবন আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান।সমস্যাহীন জীবন অকল্পনীয়।রাত-দিনের মতোই জীবনে ছন্দে সুখ-দুঃখ,সমস্যা এইসব থাকবেই।তাই এই সমস্যা নিয়ে বেশি চিন্তিত হলে চলবে না।জীবন থাকলে সমস্যা যেমন থাকবে,তেমনি তার সমাধানও থাকবে।আত্মহত্যা করা মানেই জীবনে হেরে যাওয়াকে বোঝায়।তাই আত্মহত্যা করে জীবনে হেরে না গিয়ে সমস্যার সমাধান করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হবে।সম্প্রতি দেখাগেছে, মানুষ বড়ই একাকীত্ব অনুভব করেন।মানুষ সামাজিক ও মানসিকভাবে বড়ই অসুস্থ।পারিবারিক বন্ধন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে,হারিয়ে যাচ্ছে শেয়ারিং ও কেয়ারিং এর ভাবনা।তাই হয়তো এত আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়ছে।এই প্রসঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক ডুর্খাইম বলেছেন, পারিবারিক বন্ধন আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়।তিনি এও বলেছেন যে,আত্মহত্যা হল একটি ব্যক্তিগত বিষয় যার কারণ হল অবশ্যই সামাজিক।অর্থাৎ বেশিরভাগ আত্মহত্যার কারণ কিন্তু সামাজিক।তাই এই আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে,সামাজিক ও মানসিকভাবে মানুষের পাশে থাকতে হবে,পরিবারের সদস্যদের উচিৎ কাছের মানুষদের মনের যন্ত্রণাগুলোক অনুভব করা,সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া।শাসন নয়,পাশে থাকাই প্রতিরোধ করতে পারে এই আত্মহত্যার প্রবণতাকে।পাশাপাশি চাই কাউন্সেলিং করানো,হাসি-খুশি থাকা,রোমান্টিকভাবে জীবনকে উপভোগ করা,সেল্ফ টক পদ্ধতি অনুসরণ করা,ডিপ্রেশন ও ভয় থেকে মুক্ত থাকা,নিজের জীবনের প্রতি যত্ন নেওয়া এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে যত্নের সহিত গুরুত্ব দেওয়া প্রভৃতি।পাশাপাশি প্রয়োজন মনোবিদ,কাউন্সেলর এবং ডাক্তারের পরামর্শও নেওয়া।একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, আত্মহত্যা কোনও সমস্যার একমাত্র ও শেষ সমাধান নয়।তাই এই প্রবণতা থেকে সবাই দূরে থাকুন।

বিশেষজ্ঞরা হলেন: ড.অনিরুদ্ধ চৌধুরী(সমাজতাত্ত্বিক, প্রবীণ অধ্যাপক এবং লেখক),মৌমিতা গাঙ্গুলি(মনোবিদ,কাউন্সেলর এবং স্পেশাল এডুকেটর), জয়দেব বেরা(অতিথি অধ্যাপক,লেখক ও সমাজ-মনোবিশ্লেষক)