আমি বাংলা শিক্ষক। স্কুলে ছত্রিশ বছর চাকরি করেছি। ফাঁকি দিইনি। এ অজুহাতে, সে অজুহাতে- ইচ্ছে করেই স্কুল কামাই করিনি। কেন আমাকে C. L, মেডিকেল,PCCL দেওয়া হবে না-- এই নিয়েও তুলকালাম করিনি সারা অফিস রুমে। রিটার্ড লাইফে এসে ছত্রিশ বছর চাকরি জীবনে চৌচির হয়ে গেল আমার অবসর জীবন। কেন চৌচির হয়ে গেল অবসর জীবন ,না লিখে পারলাম না।
চাকরি থাকলে অবসরের আনন্দ আছে। অবসরের মধ্যে অবসর সব সময় নিরানন্দ। যখন চাকরি করতাম তখন কোনো প্রেসার, সুগার এমন কি শরীরে কোনো রোগ ছিল না। কিন্তু এখন অবসর জীবনে এসে সুগার প্রেসার থেকে শুরু করে শরীরে হাজার রকম রোগ। এ ডাক্তার সে ডাক্তার দেখিয়ে নাজেহাল। সারাদিন কি করবো ভেবে উঠতে পারি না?
ভোরে উঠে এক ঘন্টা মর্নিংওয়াক। সকালে চা-বিস্কুট খেলাম ত্রিশ মিনিট ধরে। খবরের কাগজ পড়লাম এক ঘন্টা। দাদ হাজা থেকে চুলকানি সব খবর পড়লাম। ব্রেকফাস্ট এক ঘন্টা ধরে করলাম। এমনকি স্নানও এক ঘন্টা। দুপুর যেন হতেই চায় না। অনেক কষ্টে দুপুর হলো। লাঞ্চ সারলাম এক ঘন্টা। মশারি খাটিয়ে টানা দু'ঘণ্টা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে তাসের আড্ডায়। দোকানে লিকার চা খেতে খেতে আরও এক ঘন্টা। সন্ধ্যা যেন হতে চায় না। অনেক কষ্টে সন্ধ্যা হল। টিভির কোনো সিরিয়াল বাদ নেই। সব সিরিয়াল মুখস্ত। রাত দশটায় ভাত খেতে আরও এক ঘন্টা নিলাম। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। যখন স্কুল করতাম ঘড়ির কাঁটা যেন তাড়াতাড়ি চলতো। আজ যেন দেওয়াল ঘড়িগুলি আমার বিপক্ষে। খুবই ধীরে ধীরে কাঁটা গুলি এগোচ্ছে।
যখন স্কুলে যেতাম --নাকে মুখে গুঁজে কোনো রকমে খেয়ে চলে যেতাম। সূর্য ও চন্দ্রের দিকে তাকাবার অবসর ছিল না। এখন আমি ড্যাবা ড্যাবা চোখে সূর্য ও চন্দ্রের দিকে দিন রাত তাকিয়ে রয়েছি। তাও যেন সময় কাটতে চায় না। অবসরে যে এতো কষ্ট তখন বুঝে উঠতে পারিনি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
তখন ছেলেমেয়ে বউকে শাসন করতাম। এখন ঠিক তার উল্টোটাই ঘটছে আমার জীবনে। ছেলে মেয়ে ও বউয়ের কড়া শাসনের মধ্যে দিয়ে আমার জীবন জেলখানায় বন্দী। কয়েদির মত জীবন যাপন। আমার ছেলে পরিচয় বললো,
--বাবা, তোমাকে একদম মর্নিং ওয়ার্ক করা যাবে না।
--কেন রে খোকা?
--তোমার ঠান্ডা লাগবে। মরতে বসেছ! তার ওপর আবার মর্নিং ওয়ার্ক।
আমার মনে দুঃখের সুনামি বইছে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছি না শরীরে হাঁটা চলা আগের থেকে অনেকটা কমে আসছে।
আমার মেয়ে প্রতীক্ষা বললো,
_তোমাকে একদম ভাজা ভুজি খাওয়া যাবেনা
_কেন রে খুকি?
_ডাক্তার তোমাকে তেলে ভাজা খেতে বারণ করেছে। মরতে বসেছ তবু তেলেভাজা খাওয়ার সখ মেটেনি।
আমার মনে হ্যারিকেন ঝড় বইতে থাকে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছিনা। শরীর আগের থেকে অনেকটা ভেঙে পড়েছে।
আমার বউ পারমিতা বললো,
--হ্যাঁ গো, তুমি এখনও পর্যন্ত গল্প কবিতা লিখবে?
_আমার লিখতে যে বড় ইচ্ছে করে মিতা।
_তোমার চিতার কাঠ শ্মশানে এগিয়ে গিয়েছে। এখন আর লিখে লাভ নেই।
_একটু ঘুগনি খাওয়াবে মিতা?
_মরতে বসেছো আবার ঘুগনি! তুমি মরলে আমার শান্তি।
আমার চোখের কোণে কালো মেঘ। আকাশ চিরে বৃষ্টি ঝরছে। তবু মুখে কিছু বলতে পারছি না। এখন হাঁটাচলা বন্ধ। দরজা জানলা বন্ধ।
আমার ছেলের ঘরের ছেলে মানে নাতি। কিশলয় বললো,
_দাদু আর তোমার বেঁচে থেকে লাভ নেই।
_কেন রে দাদুভাই
_তোমার মরা ও বাঁচা সমান। তোমার টাকা কড়ি আমাকে লিখে দিয়ে যাও।
আমার বুকে যেন পাথর চাপা। মুখে কিছু বলতে পারছি না। কেননা উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আমার নেই।
আমার মেয়ের ঘরের মেয়ে, মানে নাতনি। স্বর্ণালী বলল,
--দাদু ,তুমি এখনো বেঁচে আছো। তুমি মরোনি?
_কেন রে দিদিভাই।
_আর কতদিন বিছানায় হেগে মুতে শুয়ে থাকবে। তাই বলছিলাম আর কী?
আমার সারা শরীর অবশ। মুখে কিছু বলতে পারছি না। কেননা আমার বিছানায় মলমূত্রের গন্ধ ম ম করছে।
এখন দিনরাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি নিজের মৃত্যু ,নিজেই চিন্তা করছি। পাশের বাড়ির লোকজন, আত্মীয় পরিজন সবাই আমার দিন গুনছে। কবে বুড়োটা বিদায় নেবে। তাদের একজনের কথা আমার কানে ভেসে এলো_'বুড়োটা যেন মরতেই চায় না।'
আমি এখন একা। সম্পূর্ণ একা। স্কুল জীবনের কত মধুর স্মৃতি মনে ভিড় করছে। চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। এমন একটা সময় আমাদের জীবনে আসে ,তখন সবাই আমরা একা। সম্পূর্ণ একা। হঠাৎ কানে আমার কিছু কথা ভেসে আসে..
বিধান স্যার--
_আপনার জন্য আমি ডাক্তার হতে পেরেছি।
_আপনার জন্য আমি ইঞ্জিনিয়ার।
_আপনার জন্য আমি উকিল।
_আপনার জন্য আমি অধ্যাপক।
আপনার জন্য নার্স ,পুলিশ....... এমন কি কবি ,লেখক, উপন্যাসিক........।
আমার চোখে চাঁদের ঢেউয়ের ঝর্ণা। এবার আমি নিশ্চিন্তে মৃত্যুবরণ করতে পারি। পৃথিবীতে আমি এখন আর একা নই। সুখের ঐশ্বর্যের বিছানায়_অসংখ্য কুঁড়ি মাথা দোলাচ্ছে। যমরাজ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
"বিধান স্যার, এবার অন্তত চলুন।"