Skip to content

বাংলাদেশে আন্দোলনরতদের কর্মসূচিতে এবার শামিল হওয়া শিক্ষক ও আইনজীবীদের ওপর হামলা, বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় অব্যাহত!

রোডমার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচি চলাকালে বরিশালে কয়েকজন আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থীর ওপর পুলিশি হামলার দৃশ্য৷ ৩১ জুলাই, ২০২৪

ঢাকা, জাকির হোসেন: বাংলাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তথা পড়ুয়াদের সাথে এবার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দেশের আইনজীবীরা গণহারে শামিল হয়েছেন শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায়, সারাদেশে আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, গণহত্যা, মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে৷ কোটা আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, গণহত্যা, মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বুধবার ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মূল প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'। এদিন দেশজুড়ে এই কর্মসূচি পালনকালে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি খবর সংগ্রহরত সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করে শাসকদল আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ৩১ জুলাই দুপুরের দিকে হাইকোর্টের মাজার রোডের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা৷ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ৫ জনকে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে আটক করেছে পুলিশ, শিক্ষকদের ওপরও চালিয়েছে হামলা৷ এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক আহত হয়েছেন৷ ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন হাইকোর্টের মাজার রোডের সামনে প্রথমে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। পরে আরও ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি মিছিল যোগ দিতে এলে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। এগুতে না পেরে সেখানেই বসে পড়েন শিক্ষকরা। পাশাপাশি আইনজীবীদের একটি দলও ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ লেখা ব্যানার নিয়ে সেখানে স্লোগান দেন। তাদের ওপরও হামলা করে পুলিশ৷ এর এক পর্যায়ে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ৫ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের সেখান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় এক নারী শিক্ষার্থী পুলিশ ভ্যানের সামনে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই শিক্ষার্থীকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লুৎফর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, রোড ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসেছেন। আমরা সংহতি জানাতে এসেছি। পুলিশ আমাদের আটকে দিয়েছেন, আমরা বসে পড়েছি। এরপর পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালায়৷" সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। শিক্ষার্থীরা বাধা ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে৷ ৩১ জুলাই সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত হয়েছে ৩১ জন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ৷ ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের বাধা ভেঙে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আদালত চত্বরেও প্রবেশ করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ আইনজীবীরাও। দুপুর ১২টার দিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা আদালত চত্বরে অবস্থান করে। এ সময় এনেক্স ভবনের সামনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা বিক্ষোভকারীদের বাধা দেন ও হামলা চালান৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো বরিশালেও ‘পিস ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করতে নেমেছিল শিক্ষার্থী ও অন্যান্যরা। বরিশালে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে দুই দফায় বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। পুলিশের হামলায় চার সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় বাম সংগঠনের নেতাসহ অন্তত ২০ জনকে আটক করে পুলিশ। আহত সাংবাদিকরা শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ ৩১ জুলাই বেলা ১১টার দিকে প্রথমে শহরের অশ্বিনীকুমার হলের সামনে এবং পরে সাড়ে ১২টা নাগাদ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সামনে ফজলুল হক এভিনিউতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ৷ আহত শিক্ষার্থী সেতু জানায়, "আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কয়েকশ পুলিশ ও বিজিবি সদস্য একসঙ্গে লাঠিপেটা শুরু করে। আমরা বলেছি, আমরা সড়কের পাশে কর্মসূচি পালন করব৷ আমাদের কর্মসূচিতে কোনো সহিংসতা নেই। কিন্তু পুলিশ আমাদের ওপর সহিংসভাবে লাঠিপেটা শুরু করে। কমপক্ষে ২৫ জনকে মারধর করেছে পুলিশ।" আটক শিক্ষার্থী সাইমুন পুলিশ ভ্যানে থাকা অবস্থায় বলেন, "রাষ্ট্র আমাদের সাথে অন্যায় করছে। আমরা কোনো দোষ করিনি। আমরা অধিকারের কথা বলতে এসেছি। আমরা হত্যার বিচার চাইতে এসেছি। পুলিশ বাছবিচার ছাড়া স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মারধর করেছে। আমাকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে।" গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের ব্রজমোহন কলেজ শাখার সমন্বয়ক হুজাইফা রহমান বলেন, "একেবারে বিনা কারণে পুলিশ আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমরা আজকে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বিচার দাবি করতে এসেছি। আমাকেসহ আরও অনেককে বেধড়ক পিটিয়ে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে।" প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার পর বরিশালের কাঠপট্টি সড়কের মুখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেসময় বেশ কয়েকজন অভিভাবকও ছিলেন। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বাদানুবাদের একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ টানাহেঁচড়া করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সিটি কলেজের গলির মুখে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখে। পরে কয়েকশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী একজোট হয়ে সদর রোডে অবস্থান করলে পুলিশ শুরুতে তাদের ধাওয়া দেয় পরে আচমকা লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের ওপরও লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পুলিশের হামলায় দৈনিক যুগান্তরের ফটো সংবাদিক শামীম আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন হৃদয় চন্দ্র শীল, এনটিভির ক্যামেরাপার্সন গোবিন্দ সাহা ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা টোয়েন্টিফোরের তুহিন খান আহত হন। লাঠিচার্জের প্রতিবাদে সাংবাদিকরাও সদর রোডে কিছু সময় অবস্থান করেন। পরে আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বরিশাল আদালতের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশ দ্বিতীয় দফায় লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় শিক্ষার্থীদের৷ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বরিশাল জেলার সমন্বয়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, "শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক লাঠিচার্জ করেছে। নারী, স্কুল কলেজের ছাত্রীদেরও বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। পুলিশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। গণআন্দোলন দমাতে মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।" আহত সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের আদিকারিক তানভীর আরাফাত নিজে লাঠিচার্জে ছিলেন। শুধু সাংবাদিক না যাকে যেখানে পেয়েছে পুলিশ পিটিয়েছে। এ বিষয়ে উপ-কমিশনার তানভীর আরাফাত বলেন, সাংবাদিকদের পরিচয় জেনে পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি। ভুলবশত লাঠিচার্জ পড়েছে। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করার নেই। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে খুলনায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩১ জুলাই দুপুরে মহানগরীর রয়েল মোড় ও সাতরাস্তা মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। স্থানীয়রা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করতে বুধবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। তারা নগরীর শিববাড়ী, রয়েল মোড়, সাত রাস্তা মোড়, ময়লাপোতা মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। এ সময় খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধে গেলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখান থেকে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে৷ পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা রয়েল মোড় এলাকায় এলে পুলিশ তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সাত রাস্তার মোড়ে থাকা পুলিশের দুটি গাড়ি পিছু হটলেও দুপুর সোয়া ২টার দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ শুরুর পর পুলিশ ব্যাপক কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদেরকে ছাত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশ নগরীর শান্তিধাম মোড় রয়েল মোড়, সাতরাস্তা মোড়, ফুল মার্কেট এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা নগরীর রয়েল মোড়ে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ রয়েল মোড় ও আশপাশের এলাকা থেকে কমপক্ষে ৩৫ জনকে আটক করে। পুলিশ ও বিজিবির কঠোর অবস্থানের কারণে আন্দোলনকারীরা রয়েল মোড়ে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এছাড়া নগরীর শিববাড়ী মোড়েও বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে আজ বুধবার নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পদযাত্রা করেছেন হাজারো শিক্ষার্থী। ৩১ জুলাই দুপুর আনুমানিক ১২টা নাগাদ তাঁরা শহরের মাজইদী বাজার এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। পরে মিছিলটি জেলা জজ আদালত-সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে মিলিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ওই কর্মসূচি পালন করা হয়। বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পুলিশ বাধাপ্রয়োগ করে, কিন্তু হতাহতের ঘটনা ঘটেনি৷ বগুড়ায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে জলেশ্বরীতলা রোমেনা আফাজ সড়কে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ, লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে৷ আহত হয় ৭৮ জন শিক্ষার্থী৷ নরসিংদী, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, রাজশাহী সহ দেশের প্রায় সব জায়গাতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে শাসকদল আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি হামলা করেছে, চালিয়েছে গুলি৷ পুরো দেশ মিলিয়ে ৩১ জুলাইয়ের 'রোডমার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচিতে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ মিলে তিন হাজার জন আহত হয়েছে যাদের মধ্যে ৮২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক৷

গত পহেলা জুলাই থেকে চলমান বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হলেও শাসকদল সারাদেশজুড়ে যে গণহত্যা, হামলা, মামলা, নাগরিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, তা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে৷ এরই প্রতিবাদে পুরো বাংলাদেশ এক হয়েছে শাসকদল আওয়ামী লীগের পতনের আন্দোলনে৷ শিক্ষার্থী তথা পড়ুয়াদের কোটা আন্দোলন থেকে এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার পতনের আন্দোলন, গণমানুষের আন্দোলন৷ 'আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই, বিচার চাই', 'আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না', 'জেগেছে বাংলা, স্বৈরাচার এবার পারলে তোর পতন সামলা', 'স্বৈরাচার হাসিনার পতন ঘটাও, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও' -দেশজুড়ে এরকম প্রভৃতি স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে রাজপথ৷ গদি হারানোর ভয়ে হাসিনা সরকার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতা ধরে রাখার, কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে, চলমান উচ্চ মাধ্যমিক সহ সব পরীক্ষা স্থগিত করেছে, সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেছে৷ অফিস-আদালতের কার্যক্রম পুরোদমে না চলে একপ্রকার থমকে গেছে, সাধারণ মানুষ কার্যত স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হয়ে রাস্তায় চলাফেরা করছে, মানুষের মুঠোফোন চেক করা হচ্ছে, নিরীহ মানুষকে বিনা বিচারে রাস্তাঘাটে-বাসাবাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে শাসকদলের মদতপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি৷ এককথায়, চলমান সহিংসতায় থমকে গেছে বাংলাদেশ৷ দেশজুড়ে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীর হামলা ও গুলিবর্ষণে এখন অবধি মৃতের সংখ্যা ছ'হাজার ছাড়িয়েছে৷ শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে সাংবাদিক, বাংলাদেশের সব শ্রেণির নাগরিক শিকার হচ্ছে নির্বিচারে হামলা, মামলা, গুলিবর্ষণের৷ গণহত্যার মৃত্যুপুরী আজ বাংলাদেশ৷ আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বাইশ হাজারে৷ শাসকদল বিনা বিচারে আট হাজার মানু্‌ষকে এখন অবধি জেলে পুরেছে, এই ধরপাকড় এখনও অব্যাহত রয়েছে৷
এদিকে বাংলাদেশের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর শাসকদলের মদতপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জুলুম, হামলা, মামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদে নিন্দার ঝড় অব্যাহত রয়েছে বিশ্বজুড়ে৷ এরই অংশ হিসেবে এবার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দুই মার্কিন সিনেটর। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের এই দুই সদস্য হলেন বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার। মার্কিন ফরেন রিলেশনস কমিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের  ঘটনায় জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এর মধ্যে বেন কার্ডিন সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ার হিসেবে নিযুক্ত আছেন। গত ৩০ জুলাই মঙ্গলবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, "সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সরকারি চাকরিতে বৈষম্যপূর্ণ কোটা ব্যবস্থার অবসানের দাবিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। ওই কোটা ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের স্বজনের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ন্যায্য দাবিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নৃশংসভাবে বলপ্রয়োগ করেছে। কয়েকশ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে। আরও হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতারের শিকার ও আহত হয়েছেন।" বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভ করার অধিকারকে গণতান্ত্রিক সমাজের একটি ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন এই দুই সিনেটর৷ বিবৃতিতে তারা বলেন, "নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের অভিযোগগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।" বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "এসব সাহসী মানুষ, যারা নিজেদের মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য এবং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য দাঁড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে আছে। আমরা বাংলাদেশে মানবাধিকার নিশ্চিতের পক্ষে কথা বলে যাব। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলে যাব।" বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে সৃষ্ট সহিংসতায় হতাহত এবং এ সংক্রান্ত কয়েকটি দাবির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। ৩০ জুলাই মঙ্গলবার এই চিঠি অ্যামনেস্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে৷ হাসিনাকে দেওয়া ওই চিঠিতে দুই শতাধিক নিহতের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের যথাযথ শাস্তির আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে কারফিউ বন্ধ করে সবার জন্য সামাজিক মাধ্যম খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণে হাসিনার কাছে দেওয়া চিঠিতে মোট ছয়টি দাবি করেছে সংস্থাটি।

এগুলো হলো- ১) অবিলম্বে সম্পূর্ণরূপে কারফিউ তুলে নিন। সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে মানুষেরে সম্পূর্ণ অ্যাক্সেস পুনরুদ্ধার করুন। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে বিক্ষোভ দমনে কারফিউতে ‘দেখা মাত্রই গুলি’ করার নির্দেশ ও ইন্টারনেট বন্ধ করা হবে না বা অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করা হবে না এমন নিশ্চয়তা প্রদান।

২) শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রয়োগ করার জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে ও নিঃশর্তে মুক্তি দিন।

৩) আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সংযম অনুশীলন করার নির্দেশ দিন। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার না করতে এবং এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করুন। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশিং অনুশীলনের সংশোধন এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে মানবাধিকারের মানদণ্ডে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুরক্ষা ও সুবিধা নিশ্চিত করা।

৪) বিক্ষোভ দমনের সময় নিহত ও আহতদের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ, কার্যকর, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। বল প্রয়োগের বেআইনি ব্যবহারের জন্য যারা দায়ী তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

৫) বেআইনি পুলিশি সহিংসতার শিকার এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের, যারা আহত হয়েছেন এবং যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং এই ধরনের ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার নিশ্চয়তা প্রদান করুন।

৬) বাংলাদেশের সংবিধান ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করুন। এ ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার মতো যেসব আইন বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করুন। উল্লেখ্য, এর আগেও অ্যামনেস্টি দু'বার পড়ুয়াদের এই চলমান আন্দোলনে শাসকদলের জুলুমের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল৷

Latest