নিজস্ব সংবাদদাতা : আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন। আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।
১৯৩২ সালে আকাশবাণীতে মহালয়ার সকালে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান শুরু হল। সেই সময় কী ভেবেছিলেন আকাশবাণীর তত্কালীন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার? তিনি ভেবেছিলেন, একটা নতুন কিছু শুরু হচ্ছে। মানুষের পছন্দ হলে ভাল, না হলে মহিষাসুরমর্দিনী বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি থেকে রিটায়ার করার ১৬ বছর পর, ১৯৫৬ সালে নৃপেন্দ্রনাথ লিখছেন, মহিষাসুরমর্দিনী মহাভারতের কর্ণের মতো। যাঁরা মহাভারত পড়েন, তাঁরা বাকিদের ভুলে গেলেও কর্ণকে ভুলতে পারেন না। তেমনই আকাশবাণী কোনওদিন হারিয়ে গেলেও মহিষাসুরমর্দিনী বাঙালির মনে থেকে যাবে চিরকাল।
এই বিষয়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহালয়ার সকালে এমন কোনও অনুষ্ঠান তৈরি যে হবে, এমন কোনও ভাবনাই অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কর্তৃপক্ষের ছিল না। আকাশবাণীর আড্ডায় এসে এই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন মহাস্থবীর জাতকের লেখক, সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। প্রেমাঙ্কুর বললেন, মহালয়ার দিন দুর্গাপুজোর স্লোক আর স্তোত্রকে গানের আকার দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! উপস্থিত সবাই সায় দিলেন। সেই প্রস্তাব পাশও হয়ে গেল। জানা যায়, মাত্র তিন সপ্তাহে ২০ থেকে ২২টা গান লিখে ফেলেন বাণীকুমার। বাণীকুমার অর্থাত্ বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের হাতেই সেই অর্থেই মহিষাসুরমর্দিনীর ভিত তৈরি শুরু। লেখালিখির পর তাতে সুর দেওয়া। হরিশচন্দ্র বালী, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক সুর দেন বেশিরভাগ গানেই। একটি গানে সুর দেন সাগীর খাঁ। এরপর এল চণ্ডীপাঠ। সেজন্য সেরা মানুষ হাতের কাছেই ছিলেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
হে ভগবতী মহামায়া, তুমি ত্রিগুণাত্মিকা; তুমি রজোগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগ্দেবী, সত্ত্বগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, তমোগুণে শিবের বণিতা পার্বতী, আবার ত্রিগুণাতীত তুরীয়াবস্থায় তুমি অনির্বচনীয়া, অপারমহিমময়ী, পরব্রহ্মমহিষী; দেবী ঋষি কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নী, তিনি কন্যাকুমারী আখ্যাতা দুর্গি, তিনিই আদিশক্তি আগমপ্রসিদ্ধমূর্তিধারী দুর্গা, তিনি দাক্ষায়ণী সতী;দেবী দুর্গা নিজ দেহ সম্ভূত তেজোপ্রভাবে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা। এই ঊষালগ্নে, হে মহাদেবী, তোমার উদ্বোধনে বাণীর ভক্তিরসপূর্ণ বরণ কমল আলোক শতদল মেলে বিকশিত হোক দিকে-দিগন্তে; হে অমৃতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণী হোক প্রাণময়ী।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ব্রাহ্মণ ছিলেন না। ফলে তিনি চণ্ডীপাঠ করলে গোঁড়া ব্রাহ্মণরা আপত্তি করতে পারেন, তেমন একটা আশঙ্কা ছিলই। তবে নৃপেন্দ্রনাথ সেসবে আমল দেননি। সাফ বলে দেন, স্তোত্রপাঠের আবার বামুন, কায়েত কী? কেউ বলতে এলে বলে দেব, আপনি নিজে বীরেনের মতো করে দেখান দেখি। সেই সময় রেকর্ডিংয়ের জন্য আগে থেকে কোনও স্ট্রাকচার ঠিক ছিল না। আবার বাদ্যযন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উর্দুভাষী। তারা নোটেশন ফলো না করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজাচ্ছিলেন। ঠিক হয়েছিল, তাতে ভাল হলে ভাল। না হলে ফের নোটেশন মতো বাজিয়ে রেকর্ডিং হবে। কিন্তু প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে রেকর্ডিংয়ের পর বোঝা যায়, সবটাই নিখুঁত হয়েছে। নৃপেন্দ্রনাথ পরে বলেন, আমি সবাইকে বলছিলাম, মা দুর্গা আমাদের দিয়ে কাজটা করিয়ে নিলেন। বাকিটাও মায়ের হাতেই ছেড়ে দাও। অনেকেই হয়ত জানেন, প্রথম দু’বছর ষষ্ঠীর দিন ভোরে সম্প্রচারিত হয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনী। দু’বছরের পর মহালয়ার ভোর থেকে সম্প্রচার শুরু হয়। দেবীপক্ষের আগে মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার শাস্ত্রসম্মত কি না, তা নিয়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল। এই নিয়ে বাগবাজারে এক বিতর্কসভায় দু-পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল। আর বীরেন্দ্রবাবুর জায়গায় উত্তমকুমারকে দিয়ে অনুষ্ঠান করানোর ঘটনা, সে তো সব বাঙালিরই জানা।
দেবী চণ্ডিকা সচেতন চিন্ময়ী, তিনি নিত্যা, তাঁর আদি নেই, তাঁর প্রাকৃত মূর্তি নেই, এই বিশ্বের প্রকাশ তাঁর মূর্তি। নিত্যা হয়েও অসুর পীড়িত দেবতা রক্ষণে তাঁর আবির্ভাব হয়।
আকাশবাণীর হাতে মহিষাসুরমর্দিনীর ৮ থেকে ১০টি রেকর্ডিং আছে। প্রতি বছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন রেকর্ডিং বাজানো হয়। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের রেকর্ডিংটাই সবচেয়ে বেশিবার বাজানো হয়েছে। ১৯৬৬-র রেকর্ডিংটাও বাঙালিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
পূর্বকল্প অবসানের পর প্রলয়কালে সমস্ত জগৎ যখন কারণ-সলিলে পরিণত হল, ভগবান বিষ্ণু অখিল-শক্তির প্রভাব সংহত করে সেই কারণ-সমুদ্রে রচিত অনন্ত-শয্যা ‘পরে যোগনিদ্রায় হলেন অভিভূত। বিষ্ণুর যোগনিদ্রার অবসানকালে তাঁর নাভিপদ্ম থেকে জেগে উঠলেন ভাবী কল্পের সৃষ্টি-বিধাতা ব্রহ্মা। কিন্তু বিষ্ণুর কর্ণমলজাত মধুকৈটভ-অসুরদ্বয় ব্রহ্মার কর্ম, অস্তিত্ব বিনাশে উদ্যত হতে পদ্মযোনি ব্রহ্মা যোগনিদ্রায় মগ্ন সর্বশক্তিমান বিশ্বপাতা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য জগতের স্থিতি-সংহারকারিণী বিশ্বেশ্বরী জগজ্জননী হরিনেত্র-নিবাসিনী নিরূপমা ভগবতীকে স্তবমন্ত্রে করলেন উদ্বোধিত। এই ভগবতী বিষ্ণুনিদ্রারূপা মহারাত্রি যোগনিদ্রা দেবী।
ওগো আমার আগমনী আলো,
জ্বালো প্রদীপ জ্বালো।
এই শারদের ঝঞ্ঝাবাতে
নিশার শেষে রুদ্রবাতে
নিভল আমার পথের বাতি
নিভল প্রাণের আলো।
ওগো আমার পথ দেখানো আলো
জীবনজ্যোতিরূপের সুধা ঢালো ঢালো ঢালো।
দিক হারানো শঙ্কাপথে আসবে,
অরুণ রাতে আসবে কখন আসবে,
টুটবে পথের নিবিড় আঁধার,
সকল দিশার কালো।
বাজাও আলোর কণ্ঠবীণা
ওগো পরম ভালো।