নিজস্ব সংবাদদাতা : রবিবার বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় শ্রীলঙ্কার কলম্বোর পি সারা ওভালে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখা গেল— দৃষ্টিহীন নারীদের ক্রিকেটে ভারতের মেয়েরা জিতে নিলেন উদ্বোধনী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ফাইনালে ভারত ৭ উইকেটে নেপালকে হারিয়ে অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন হল ভারত। জাতীয় পতাকা হাতে নীল জার্সির কন্যারা যখন মাঠজুড়ে গোল্লাছুট দিয়ে ছুটে এলেন, তখন তাঁদের মধ্যে কারও চোখে আলো নেই— কিন্তু মন, সাহস ও উপলব্ধির আলোয় তাঁরা উজ্জ্বল। খেলার মাঠে সেই উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল ছোঁয়ায়, শব্দে, আলিঙ্গনে। কেউ আংশিক দৃষ্টিহীন, কেউ সম্পূর্ণ। কিন্তু ক্রিকেট বলের ঝুমঝুমি আওয়াজই হয়ে উঠেছে তাঁদের চোখ— তাঁদের পথনির্দেশ। সেই শব্দের ছন্দে তাঁরা ব্যাট চালিয়েছেন, ফিল্ডিং করেছেন, ক্যাচ ধরেছেন; আর সেই শব্দেই খুঁজে পেয়েছেন একে অপরকে। ভারতীয় দল পুরো টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচও হারেনি— কিন্তু দেশ জুড়ে সেই খবর আলো ছড়ায়নি প্রধান ধারার ক্রিকেটের মতোই জোরে। তবু মেয়েরা থামেননি। তাঁরা আত্মবিশ্বাসের আলোয় অন্ধকার ভেদ করেছেন।

অধিনায়ক দীপিকা, কর্ণাটকের দূর গ্রামের মেয়ে। ছোটবেলার দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন আংশিকভাবে। কখনও ভাবেননি ক্রিকেট তাঁর পরিচয় বদলে দেবে। আজ তিনি ভারতের দৃষ্টিহীন দলের নেতা, আয়কর দফতরের কর্মী, পরিবারের ভরসার আলো। ট্রফি হাতে তাঁর কণ্ঠে নীরব প্রতিবাদ—“আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, আমরা কী করতে পারি।” সহ-অধিনায়ক গঙ্গা কদম মহারাষ্ট্রের গ্রামের মেয়ে। ৯ ভাইবোনের সংসারে ভাগ্যের টানে ভর্তি হয়েছিলেন দৃষ্টিহীনদের স্কুলে। সেখানেই ধরা পড়ে তাঁর প্রতিভা। আর কাব্য— সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন ‘বি ওয়ান’ খেলোয়াড়— পরিবার বিদেশযাত্রায় আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের সব দরজা ভেঙে তিনি পৌঁছে গেছেন বিশ্বকাপ মঞ্চে। আজ তাঁর গলায় বিশ্বজয়ের মেডেল।তাঁদের মতোই ওড়িশার বাসন্তী হাঁসদা, অন্ধ্রপ্রদেশের করুণা কুমারী— প্রত্যেকের পথচলা প্রতিকূলতার সূচিভেদী গল্প।

দৃষ্টিহীন ক্রিকেটে বলের ভেতরে থাকে বল-বিয়ারিং। আন্ডারআর্ম বলে যখন বল গড়িয়ে আসে, তখন তার ঝুমঝুমি শব্দই ব্যাটারদের চোখ হয়ে ওঠে। ফিল্ডাররাও সেই শব্দেই ছুটে যান বলের দিকে। একই শব্দে তাঁরা সতীর্থদের সতর্ক করেন, আবার সেই শব্দেই তৈরি হয় যোগাযোগ— এক অদৃশ্য সেতু, যা মাঠে আলো জ্বালায় অন্ধকারের ভেতরেও। দলের কোচ, কর্নাটকের প্রাক্তন ক্রিকেটার চন্দু বলেন—“এই সীমিত সামর্থ্য নিয়ে এতদূর আসা অলৌকিক। সরকার ও বিসিসিআই একটু বেশি সাহায্য করলে আরও মেয়ে এই খেলায় আসবে।” আসলে, এই বিশ্বজয় কেবল ক্রিকেটের জয় নয়— সমাজের আরোপিত প্রতিকূলতাকে ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার জয়। এই জয় শুধু ক্রীড়া ইতিহাসের নয়— মানবিক শক্তির, অদম্য ইচ্ছাশক্তির, অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প। তাঁদের প্রতিটি আঙুলে, প্রতিটি পায়ে, প্রতিটি ঝুমঝুমি-বলছোঁয়ায় জেগে উঠেছে এক মহাকাব্য।

উল্লেখ্য, ফাইনালে নেপাল প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৫ উইকেটে তোলে ১১৪ রান। তাঁদের ইনিংসে সারিতা ঘিমিরে (৩৫) ও বিমলা রায় (২৬) ছাড়া আর কেউ দু’অঙ্কের ঘরে পৌঁছতে পারেননি। ভারতের বোলারদের মধ্যে যমুনা রানি টুডু ও অনু কুমারী নেন একটি করে উইকেট। জবাবে ভারত লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই ম্যাচকে নিজেদের দখলে রাখে। মাত্র ১২.১ ওভারেই ভারত জয় তুলে নেয় ৩ উইকেট হারিয়ে। দলের হয়ে ফুলা সারেন খেলেন অসাধারণ ইনিংস— ২৭ বলে অপরাজিত ৪৪, যার মধ্যে ছিল ৪টি চার। করুণা কে-ও দারুণ ব্যাটিং করে ২৭ বলে ৪২ রান যোগ করেন। দু’জনে মিলে নেপালের বোলিংকে চাপে ফেলে দিয়ে নিশ্চিত করে দেন ভারতের ঐতিহাসিক বিশ্বজয়।