নিজস্ব সংবাদদাতা : ১৪ই নভেম্বর শুক্রবার রাজ্যের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ১৯২ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপিত হলো যথাযোগ্য মর্যাদায় সঙ্গে। এদিন সকালে বিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ঐতিহ্যবাহী থাকা ঐতিহ্যবাহী বট গাছে মাল্যদান করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিমানী পড়িয়া। প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্যরা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে অবস্থিত মনীষীদের ও বিপ্লবী দের মূর্তিতে মাল্যদান করেন। বিদ্যালয়ের ছাত্ররা লাইন করে দাঁড়িয়ে ১৯২ এর প্রতিকৃতি তৈরি করে।কেকও কাটা হয়।

সন্ধ্যায় ফানুস ওড়ানো হয় এবং আতসবাজির প্রদর্শনী হয়। প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে গোটা বিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস সেজে উঠেছে রঙিন আলোকমালায়।১৮৩৪ সালের ১৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল, শুরুতে স্কুলটি মেদিনীপুর সরকারি জিলা স্কুল হিসাবেই পরিচিতি ছিল। বাংলা তথা ভারতের প্রাচীনতম স্কুলগুলির মধ্যে একটি স্কুল হিসাবে মান্যতা পায় এটি। এই স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকরা ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন ছাত্র হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়।

প্রধান শিক্ষক হিসেবে ব্রাহ্মসমাজের নেতা ঋষি রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে অবদান রেখেছিলেন। মেদিনীপুর জেলা ভাগের পর স্কুলটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত।ইতিহাস বলছে, স্কুলটি মেদিনীপুরের তৎকালীন সাধারণ মানুষদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তেজচন্দ্র মেহতাব রায়বাহাদুর অর্থনৈতিক সাহায্য করেছিলেন স্কুল প্রতিষ্ঠায়। স্কুলটি কয়েকটি খড়ের ঝুপড়ি এবং ১৮ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল।

প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন রসিকলাল সেন এবং যাত্রা শুরুর মাত্র দুই বছর পর ১৮৩৬ সালে স্কুলটি সরকারি জিলা স্কুলের মর্যাদা পায়। ১৮৫৭ সালে স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আসে।ব্রিটিশ আমলে স্কুলের হেডমাস্টার স্যার এফ. টাইড এবং মিস্টার সিনক্লেয়ারের সময় তাঁদের চিন্তাভাবনায় স্কুল পরিচালিত হতো। তাঁরা মনে করতেন “জ্ঞান প্রচারের সহজতম এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসাবে পণ্ডিতের অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে শিক্ষাদানের জিজ্ঞাসাবাদমূলক পদ্ধতিটি যত্ন সহকারে অনুসরণ করা উচিত।” রাজনারায়ণ বসু, সমাজ-ধর্মীয় সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ ১৮৫১ সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৫ বছর পর ১৮৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তখন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মেদিনীপুরের আরেক কৃতি সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি শিক্ষা পরিষদের আদেশ পেয়েছিলেন যে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রাজনারায়ণ বসুকে মেদিনীপুর স্কুলের চতুর্থ প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হোক। রাজনারায়ণ বসু তখন ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের অন্যতম একজন ও বাংলার একজন তরুণ নেতা হিসাবে পরিচিত।

রাজনারায়ণ বসু ২১ জানুয়ারি ১৮৫১ সালে প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। তিনি সেই সময়ের এমন একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন, যিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ সংস্কারের সূচনা করেছিলেন। তিনি পড়ুয়াদের উপর শারীরিক শাস্তি রহিত করেন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক পরিবেশের প্রবর্তন করেন।

ক্ষুদিরামের রাজনৈতিক গুরু, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে ওই ১৯০৮ সালের ২৩ নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়। স্কুলের আরেক প্রাক্তন ছাত্র অনাথবন্ধু পাঞ্জা ১৯৩৩ সালে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন। অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডিকে ৭ এপ্রিল ১৯৩১ সালে স্কুলের ভিতরে দুই মুক্তিযোদ্ধা শ্রী বিমল দাশগুপ্ত এবং জাতিজীবন ঘোষ গুলি করে হত্যা করেছিলেন।সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলিতে, স্কুলে প্রবোধ কুমার বন্দোপাধ্যায় নামে একজন ছাত্র ছিলেন যিনি ১৯২৬ সালে বাধ্যতামূলক এবং ঐচ্ছিক গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্য জগত তাঁকে ভিন্ন নামে চেনে, তিনি হলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়।ঋষি রাজনারায়ণ বসুর আদর্শকে সামনে রেখে স্কুলের পঠনপাঠন চলছে নিজস্ব পথ ধরে আজ ও।