ঢাকা, জাকির হোসেন: ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি জলের কারণে ভয়াবহ বন্যার কবলে বাংলাদেশের দশটি জেলা। বন্যা দেখা দিয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে৷ সেখানে জলবন্দি হয়ে আছেন কয়েক লাখ মানুষ৷ এখন অবধি মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭-এ৷ ১০ জেলার মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৩০ লাখ৷
এই অবস্থায় বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে নেমে পড়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার৷ বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষদের সাহায্যের জন্য দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রসঙ্গত, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি ত্রিপুরায়। সেখানে একাধিক নদীর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে, ভারী বৃষ্টি হচ্ছে বাংলাদেশেও যা আগামী কিছুদিন চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর৷ এই ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে আসা জলের কারণেই বাংলাদেশের দশটি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। সেখানে প্রায় সব নদ-নদীর জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে সড়কে ভাঙন এবং জল ওঠায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফেনী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যার জলে ডুবে এক অন্তঃসত্ত্বা সহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। দুদিনে কুমিল্লায় অন্তত চারজন মারা গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সবমিলিয়ে এখন অবধি সাতজনের মৃত্যুর খবর এসেছে৷ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ফেনীর চার লাখেরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন জানিয়েছেন আধিকারিকরা। সেইসঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সেই এলাকায়। তলিয়ে গিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েও। এতে চরম দুর্ভোগ এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম জানান, "মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হুহু করে লোকালয়ে জল ঢুকছে।" গত মাসেই সেখানে কিছু বাঁধ মেরামত করা হয়েছিল। ফলে দেড় মাসের মধ্যেই আবার বন্যার কবলে পড়েছেন ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ, মোগড়া ও উত্তর ইউনিয়নের ৩৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একই ভাবে গোমতী নদীর জল বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তলিয়ে গিয়েছে কুমিল্লার অনেকগুলো গ্রাম। প্লাবিত হয়েছে হবিগঞ্জ, মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ মৌলভীবাজার, কুলাউড়া এবং নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেখানের বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। এই সব এলাকায় ত্রাণ এবং উদ্ধারকাজের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান আধিকারিকরা। সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা ধরনের সংস্থা বন্যা কবলিত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসছে, ব্যক্তি উদ্যোগেও সাহায্য করা হচ্ছে, পাশাপাশি 'ফান্ড রেইজ' করার কাজও চালাচ্ছে নাগরিকরা৷ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ এক হয়েছে বন্যা কবলিত মানুষের সাহায্যে৷ বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী৷ তারা ত্রান কার্যক্রম শুরু করেছে৷ জামায়তের কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান সহ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা ২২ আগস্ট ফেনী, নোয়াখালী সহ বন্যা কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷ এসময় আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, "আমি বক্তব্য দিতে আসিনি। আমি এসেছি আপনাদের দুঃখ ভাগাভাগি করতে। মানুষ দুঃখ ও দুর্ভোগের মধ্যে আছে। অনেকে ঘর বাড়িতে থাকতে পারছে না। কোলের সন্তান নিয়ে কোথায় যাবে হন্য হয়ে উঠেছে। তাদের একটু সহানুভূতির প্রয়োজন। তাদের মাঝে আমাদের সাহায্যের হাত অব্যাহত থাকবে। এখন থেকে আগামী এক সপ্তাহ আমাদের স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে ছুটে যাওয়াই এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান কাজ।" এদিকে এই বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভিযোগ, ত্রিপুরার গোমতী নদীর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে ব্যাপারটি নিয়ে তোলপাড় চলছে, নেটিজেনদের রব উঠেছে 'ভারত বয়কট' এর৷ বাংলাদেশের অভিযোগ, ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে সেখানের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে, বাংলাদেশের এই দাবি বাস্তবে সঠিক নয়। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, "ত্রিপুরার গোমতী বাঁধ থেকে জল ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়নি।" যখন প্রয়োজন তখন ভারত জল না দিলেও প্রয়োজন ছাড়া বাঁধ খুলে দিচ্ছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে এই পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও। তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিবেশী দেশ কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই বাঁধ খুলে দিয়েছে।" ভারত বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। তারপরেই ভারতের বিদেশমন্ত্রক একটি বিবৃতি দিয়ে ওই দাবির বিপরীতে তাদের অবস্থান জানান দেয়৷ বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গোমতী নদীর উপরে তৈরি ডুম্বুর বাঁধ থেকে জল ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে, এই তথ্য সঠিক নয়। বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গত কয়েকদিন ধরেই দু’দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। বাঁধের নিচের দিকে জলের প্রবাহের কারণেই বাংলাদেশে এই বন্যা হয়েছে। তাছাড়াও ওই বাঁধ বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানে থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার ভাগ পায় বাংলাদেশও। বন্যা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বাংলাদেশকে জানানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক।
এদিকে, বাংলাদেশে সৃষ্ট বন্যা নিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এই বিবৃতির সুরেই কথা বললেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা৷ পানির উচ্চতার কারণে বাঁধ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে এ কথা বলেন তিনি। পরে বিকেলে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান। সাক্ষাতের সময় প্রণয় ভার্মা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের কারণে বাংলাদেশে ভারতীয় স্থাপনার নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগের কথা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানান। প্রেস সচিব আরও জানান, বন্যাদুর্গত সব জেলায় পরিদর্শনে যাবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আযম দুর্যোগপ্রবণ এলাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন৷ প্রসঙ্গত, দু’দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৫৪টি নদী। দু'দেশই আলোচনার মধ্যে এই নদী নিয়ে সমস্যা মেটাতে পারে বলেও জানানো হয়েছে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের ওই বিবৃতিতে। এই সমস্যা মেটাতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানানো হয়েছে তাতে৷