Skip to content

মধ্যরাতে উত্তাল বাংলাদেশ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল ছেড়ে রাস্তায় পড়ুয়ারা!

মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি!

ঢাকা জাকির হোসেন: 'তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার', 'কে বলেছে? সরকার। কী বলেছে? রাজাকার', 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার' -মধ্যরাতে এই স্লোগানগুলোতে প্রকম্পিত হয়েছে পুরো বাংলাদেশ৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে দেশের শিক্ষার্থীরা দলে দলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷

১৪ জুলাই রোববার রাত ১১টা নাগাদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া তথা শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে৷ মিছিল ও শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি শেষে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যায়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলসহ প্রত্যেকটি হলের শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কবি জসিম উদ্দিন হল, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়াউর রহমান হল সহ বিজ্ঞান অনুষদের হলগুলোর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ও স্লোগানে মুখর করে তোলে ঢাকার রাজপথ। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দেওয়া ঠেকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও স্যার এ. এফ. রহমান হলের শিক্ষার্থীদেরকে আটকে রাখার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে হলগুলোর ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এসে এই হলগুলোর মূল গেটের তালা ভেঙে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরকে উদ্ধার করে মিছিলে যুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ছাত্রলীগ হচ্ছে বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন৷ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, "সূর্যসেন হল, মুহসীন হল, বিজয় একাত্তর হল, স্যার এ. এফ. রহমান হল ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আটকে রাখা শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে মিছিলে যুক্ত করা হয়। জহুরুল হক হলের টিভি রুমে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা হয়েছিল তবে প্রতিটি হলই স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল৷"

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, "বিজয় একাত্তর হলের গেটে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছে -এমন খবর পেয়ে তাঁদের বের করে আনতে গিয়েছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সেখানে তার ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।" আন্দোলনে অংশ নেওয়া আরেক শিক্ষার্থী বলল, "দেশের অধিকাংশ মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ সব কোটার সংস্কার চায়৷ দেশের মানুষ চায় মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হোক।" এদিকে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) রাজু ভাস্কর্য থেকে মশাল মিছিল কর্মসূচির ডাক দেয় একদল শিক্ষার্থী। তাদের একজন বলল, "আবাসিক হলগুলোর সামনে হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে যোগ দিতে বাধা দেয়৷ কিন্তু বাধা দিয়ে কাজ হয়নি। শিক্ষার্থীরা হলগুলোর গেটে জড়ো হয়ে হলের গেট ভেঙে বের হয়ে এসে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়।"

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে যখন সারাদেশে সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সরব, ঠিক সেই মুহূর্তে ১৪ জুলাই রোববার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতিপুতিরা কেউ মেধাবী না তো কি যত রাজাকারের বাচ্চারা নাতিপুতিরা মেধাবী তাই না? কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যাদেরকে মেধাবী না বলছে, তাদের হাতে কিন্তু পরাজিত হয়েছিল৷...তাহলে তাদের মেধাটা কোথায়?" প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য হচ্ছে, "কোটা সংস্কারের দাবিতে পুরো দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করছে৷ আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে৷ আমরা কোটাব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলছি৷ আমরা বলছি না যে কার মেধা আছে আর কার মেধা নেই৷ আমরা বলছি কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের নিয়োগ হোক৷ যদি কোটা থাকেই তবে তা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসুক৷ ১০০ ভাগের ৫৬ ভাগই যদি কোটায় নিয়ে যায় তবে সাধারণদের জন্য বাকি আর কী থাকে! ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী এরকম একটা মন্তব্য করেছেন যে আমাদের দেশভক্তি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলছেন! অথচ আমরা আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে লালন করে চলেছি এবং আমরা রাজাকার পরিবারেরও সন্তান নই৷ কোটা সংস্কার বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াই৷ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লড়াই না৷"

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

এদিকে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে খোদ তার দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তিন নেতা পদত্যাগ করলেন! পদত্যাগকারী তিন নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন৷ তারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক উপসম্পাদক রাতুল আহামেদ শ্রাবণ এবং আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান জিম। তারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷ তারা স্লোগান দিতে দিতে বিশাল মিছিল সহকারে ঢাকার পলাশী, আজিমপুর, নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে মধ্যরাতে হল ছেড়ে রাজপথে নেমে আসে৷ বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে, প্রতিবাদের অগ্নিটংকারে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ৷ এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে দুইজন আহত হয়েছেন। মধ্যরাতে ক্যাম্পাসের কাটা পাহাড় সড়কে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত সোয়া ১১টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে 'তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার', 'চেয়েছিলাম ন্যায় বিচার, হয়ে গেলাম রাজাকার' প্রভৃতি স্লোগান দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রলীগের ৪-৫ জন নেতাকর্মী কাটা পাহাড় এলাকায় আসে। সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝেই কয়েকটি বাজি ফোটায় তারা। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পিছু হটে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কাটা পাহাড় দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করে। পরে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন অন্তত চার থেকে পাঁচজনকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আহত দুজন হলেন—সুমন ও সুমাইয়া। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা বলেন, "কোটা সংস্কারের আন্দোলনে হঠাৎ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী লাঠি নিয়ে হামলা করেন। আন্দোলনরত কয়েকজনকে চড়-থাপ্পড় মারেন। নারী শিক্ষার্থীদের গালাগাল করেন। এতে প্রায় চার-পাঁচজন আহত হন। পরে একে একে সব পক্ষের নেতাকর্মীরা জিরো পয়েন্টে আসেন। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।"

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচির চিত্র

Latest