ঢাকা জাকির হোসেন : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের আনুষ্ঠানিক দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে চীন। আগামী ৮ থেকে ১০ জুলাই এই সফর হবে জানিয়েছে দেশটি। ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, স্টেট কাউন্সিলের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ থেকে ১০ জুলাই চীনে সরকারি সফর করবেন।
শেখ হাসিনার ভারত সফরের পরপরই এই চীন সফর নিয়ে তৈরি হয়েছে কৌতূহল৷ দীর্ঘদিন পর দ্বিপক্ষীয় এ সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অন্তত ১৫ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে৷ শেখ হাসিনা চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং ও রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন৷ বিশেষ করে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকেই সবার নজর থাকছে৷
কূটনীতিকরা বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে চায় চীন, যে কারণে শেখ হাসিনাকে বেইজিং সফরে নেয়ার জন্য গত বছর থেকেই নানা চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। আগামী জুলাইয়ে হতে যাওয়া এই সফরের প্রাক্কালে বর্তমান ভূ-রাজনীতির মেরুকরণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় বেইজিংয়ের বিষয়টিও সমানভাবে উঠে এসেছে। একদিকে ভারত চীনের সঙ্গে তার সীমান্তে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা মোকাবিলা করছে, অন্যদিকে চীন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে চাইছে। এরকম পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার বর্তমান চীন সফরে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনি ঢাকার দিল্লি আর বেইজিংয়ের সঙ্গে ত্রিভুজ সম্পর্কের ফলাফল কী দাঁড়ায় সেদিকেও দৃষ্টি পড়েছে তীক্ষ্ণভাবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। কারণ এই সফর ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগিতা ও সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি চীনকে বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদার উল্লেখ করলেন! হাছান মাহমুদ বলেন, তারা বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর বিষয়েও আলোচনা করবেন। শেখ হাসিনার চীন সফরে বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এসব বিষয় এখন চূড়ান্ত হচ্ছে।
হাসিনার এই চীন সফরের দিকে যেমন নজর রাখছে ভারত, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও। কিছুদিন পূর্বে অনুষ্ঠিত ভারত সফরের ওপর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভারত এবং চীনের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিরই অংশ। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় ছিল ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। আর তিনি সেই নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তিনি এটাও বলেন, ভারতের সঙ্গে চীনের খারাপ সম্পর্ক -ওই দুই দেশের বিষয়; বাংলাদেশের বিষয় নয়। কাজেই চীন এবং ভারতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে চলবে বাংলাদেশ।
সুতরাং ভারতের সঙ্গে চীনের খারাপ সম্পর্কের মাঝে হাসিনার চীন সফরের দিকে তাকিয়ে থাকবে ভারত। এই সফরের বিভিন্ন চুক্তি এবং সম্পর্কের ওপরও নজর রাখবে দেশটি। যদিও হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় চীনের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, শেখ হাসিনার বেইজিং সফর একটি ‘গেমচেঞ্জার’ হবে। পাশাপাশি এই সফরের মধ্য দিয়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। তার মতে, সফরে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হতে পারে। কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়াও ওয়েনের উচ্চারণ করা ওই 'গেমচেঞ্জার' আসলে কি হতে চলেছে সেটাই দেখার বিষয়৷ হাসিনা মুখে ভারতপ্রীতির কথা বললেও চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ভারতের বিরুদ্ধেই এবার চীনকে এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছেন কি না, কিছু সময় গেলেই তা পরিষ্কার হতে পারে৷ এজন্য সতর্ক থাকতে হবে ভারতকে৷
অন্যদিকে চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক নির্ভরতায় যুক্তরাষ্ট্র এই সফরের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কারণ এই অঞ্চলে এখন চীনের একাধিপত্য প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং নেপালের মতো দেশগুলো চীনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং সেখানে মার্কিন প্রভাববলয় প্রায় নিঃশেষিত। এই বাস্তবতায় হাসিনার চীন সফরে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক বিষয়ের বাইরে রাজনৈতিক কোনো মেরুকরণ হয় কিনা সেটি দেখার অপেক্ষায় আছে কূটনৈতিক মহল।
সূত্র জানায়, বর্তমানে যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে, তা থেকে উত্তরণে চীনের কাছ থেকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ চাইতে পারে বাংলাদেশ। আর্থিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ। এর মধ্যে বাণিজ্য সহায়তার আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তার আওতায় ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বাংলাদেশকে ঋণ দেবে চীন। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যেভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় টাকা-ইউয়ানে লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে দু'দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।
শেখ হাসিনা গত মাসে সংক্ষিপ্তভাবে পরপর দু’বার ভারত সফর করেন। প্রথমটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টানা তৃতীয় মেয়াদে অভিষেক উপলক্ষে, আর দ্বিতীয়টি ছিল পূর্বঘোষিত আনুষ্ঠানিক সফর। শেখ হাসিনার উভয় সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও দ্বিতীয়টি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
ওই সফরেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত গঙ্গা পানিচুক্তির নবায়নসহ প্রায় ১০টি সমঝোতা হয়৷ পাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয়, ‘তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পে যুক্ত হবে ভারত। গত মাসে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে নরেন্দ্র মোদী নিজেই জানিয়েছিলেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার জন্য শিগগির বাংলাদেশ ভ্রমণ করবে ভারতের একটি টেকনিক্যাল টিম।
তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪ অভিন্ন নদী রয়েছে। আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জল প্রকল্পে সহযোগিতা করছি। আমরা ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি নবায়নের জন্য টেকনিক্যাল পর্যায়ে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিস্তা নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে ভারতের প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্তটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই প্রকল্পে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী চীন। এ নিয়ে জোরালো আপত্তি রয়েছে দিল্লির। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তিতে চুক্তিটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। ২০২০ সালে প্রথমবার তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে আগ্রহ দেখায় চীন। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এই প্রকল্পে আবারও তাদের আগ্রহের কথা জানান। শোনা যায়, আগের চেয়ে অনেক কম খরচেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নতুন করে প্রস্তাব দিয়েছে বেইজিং। তিস্তা ইস্যুর সংবেদনশীলতা এবং এই প্রকল্পে চীন জড়িত হওয়ার সম্ভাবনায় উদ্ভূত ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ভারত।
ভারত সফরের দু’সপ্তাহের মাথায় ৮ জুলাই চীনে যাচ্ছেন হাসিনা। এই সফরে উঠে আসতে পারে তিস্তা প্রকল্পের কথাও। এই বিষয়টি নিয়েই বিশেষভাবে চিন্তিত ভারত। নয়াদিল্লি চায় না, তাদের আরও একটি সীমান্তের কাছে চীনের কোনো ধরনের উপস্থিতি থাকুক।
হাসিনা-মোদী বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা বলেছিলেন, অভিন্ন পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়। তিনি জানান, 'ভারতের টেকনিক্যাল টিম তিস্তার পানি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মূল্যায়ন করবে৷' কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ভারতের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট সংকেত যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় বেইজিংয়ের জড়িত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ অবস্থায় আগামী সপ্তাহে হাসিনার চীন সফরে যেসব চুক্তি হতে পারে, সেগুলোর দিকে সন্দেহাতীতভাবেই সতর্ক দৃষ্টি থাকবে ভারতের।
এদিকে শাসকদল আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বললেন, 'অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে চীনকে পাশে দরকার বাংলাদেশের৷ চীনের সুবিধা হচ্ছে দে হ্যাভ দ্য মানি, সারপ্লাস মানি। আর দেখেন ভারতও কিন্তু চায়নার থেকে কর্জ নেয়। অন্যরা কর্জ নিলে তাদের গা জ্বালা করে, কিন্তু তারা নিজেরা নেয়৷'
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'চীনের সাথে আমাদের পার্টনারশিপ আছে উন্নয়নের। ভারত আমাদের রাজনৈতিক বন্ধু, চীন আমাদের উন্নয়নের বন্ধু।' তিনি আরও বলেন, 'ভারত আমাদের একাত্তর সালের পরীক্ষিত বন্ধু। একাত্তর সালের রক্তের রাখী বন্ধনে আমাদের এই সম্পর্ক আবদ্ধ।'