নিজস্ব সংবাদদাতা : ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কমরেড নেতা দীপক সরকার ১৩ অক্টোবর সোমবার রাত ১১ টায় প্রয়াত হলেন । অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার রাজনীতিতে এক নক্ষত্রের পতন ঘটেছে, সিপিআইএমের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক, রাজ্য রাজনীতির অন্যতম বর্ণিল চরিত্র অধ্যাপক দীপক সরকার।প্রবীণ বামপন্থী নেতা দীপক সরকার মেদিনীপুর শহরের বিধাননগরে নিজের বাসভবনে রাত সোমবার রাত ১১ টায় প্রয়াত হলেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
দীপকবাবু রেখে গেলেন পুত্র ডাঃ সুদীপ্ত সরকার,কন্যা শর্মিষ্ঠা দাস, পুত্রবধূ সুজয়া সরকার,জামাতা ও নাতি নাতনিদের। পাশাপাশি রেখে গেলেন অসংখ্য গুণগ্রাহীকে।১৯৪০ সালের ২২ শে মার্চ চন্দ্রকোনা টাউন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন দীপক সরকার।কর্মজীবনে শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছিলেন নির্মল হৃদয় আশ্রম স্কুলে।অধ্যাপনা করেছেন পুরুলিয়ার রঘুনাথ পুর কলেজ ও মেদিনীপুর কলেজে। দায়িত্ব পালন করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান হিসেবে। স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা কমিউনিস্ট নেতা সুকুমার সেনগুপ্তর আহ্বানে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে চষে বেড়িয়েছেন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার লালগড়, বেলপাহাড়ি, গোপী বল্লভপুর ঝাড়গ্রাম, শালবনী, গোয়ালতোড় গড়বেতা, মেদিনীপুর, খড়্গপুর,ঘাটাল,দাঁতন, নারায়নগড়,থেকে এগরা কাঁথি,এগরা, হলদিয়া, তমলুক,পাঁশকুড়া জুড়ে।বয়সের ভারে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সক্রিয়তা কিছুটা কমলেও দলীয় কার্যালয়ে যাতায়াত ছিল নিয়মিত।১৩ অক্টোবর সোমবার সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেক বাড়ির কাছাকাছি পার্টি অফিসে গিয়ে কিছুটা সময়ও কাটিয়েছিলেন দীপক সরকার।কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিভে গেল মেদিনীপুরের এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায়। পার্টির কাজ ছাড়াও লেখাপড়া অনেক সময় কাটাতেন তিনি।

তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ,যিনি কেবল রাজনীতিবিদ নন, তিনি ছিলেন এক আদর্শবাদী শিক্ষক, এক ত্যাগী সংগঠক, আর অবিভক্ত মেদিনীপুরের উন্নয়নের অন্যতম রূপকার। মেদিনীপুর কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রদের কাছে ছিলেন প্রেরণার প্রতীক, আবার রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অকুতোভয়ে দৃঢ়তার সাথে।১৯৯২ থেকে ২০১৫ টানা ২৩ বছর সিপিআই(এম)-এর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ও পশ্চিম মেদিনীপুর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সংগঠন মানে কেবল দল নয়, মতাদর্শকে পাথেয় করে এক অদম্য বিশ্বাস, এক নিরন্তর সংগ্রাম।অবিভক্ত মেদিনীপুরে নানা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের তিনিই ছিলেন অন্যতম কান্ডারী।

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ ক্ষুদিরাম পরিকল্পনা ভবন, জেলা স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমি, বিদ্যাসাগর ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, বিদ্যাসাগর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক,ডেবরা কলেজ ,কুলটিকরী কলেজ,গোয়ালতোড় কলেজ, কেশপুর কলেজ সহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম কান্ডারী।প্রতিটি প্রকল্পের পেছনে ছিল তাঁর চিন্তা ও সুসংহত পরিকল্পনা।তিনি তাঁর সহযোগীদের সাথে নিয়ে সেগুলো রূপায়িত করেছেন। এমনকি মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ গড়ে ওঠার স্বপ্নও বাস্তবে রূপ পেয়েছিল তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায়।তিনি জানতেন, উন্নয়নের প্রকৃত মানে কেবল ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়, মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন।২০১৫ সালে জেলা সম্পাদক পদ থেকে নিজেই সরে দাঁড়ান।পরে ২০২২ সালে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী থেকেও অবসর নেন।তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুরের আকাশ যেন একটুখানি নিঃশব্দ হয়ে যায়। দলমত নির্বিশেষে মানুষ স্মরণ করে এক নিঃস্বার্থ কর্মীকে, এক চিন্তাশীল নেতাকে, এক সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতাকে।

মঙ্গলবার সকালে প্রথমে তাঁর মরদেহ যায় তাঁর গড়ে তোলা বিদ্যাসাগর ইন্সটিটিউট অব হেলথে। সেখান থেকে মরদেহ পৌঁছায় তাঁর গড়ে তোলা আর এক প্রতিষ্ঠান মেদিনীপুর স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমীতে। সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান একাডেমীর কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।এর মরদেহ মেদিনীপুর কলেজে আসে । সেখানে শ্রদ্ধা জানান কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক সত্যরঞ্জন ঘোষ সহ অন্যান্যরা।এর পর মরদেহ জেলা সিপিআইএম কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয় সেখানে শ্রদ্ধা জানান সিপিআইএম এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম,রাজ্যানেতা ডাঃ সূর্যকান্ত মিশ্র,শ্রীদীপ ভট্টাচার্য,পলাশ দাশ,অভয় মুখার্জি, সিপিআইএম এর জেলা সম্পাদক বিজয় পাল, প্রাক্তন দুই জেলা সম্পাদক তরুণ রায় ও সুশান্ত ঘোষ,কৃষকসভার জেলা সম্পাদক মেঘনাদ ভূঁইয়া,সিটুর জেলা সম্পাদক গোপাল প্রামাণিক সহ সিপিআইএম অন্যান্য জেলা নেতৃত্ব ও এরিয়া কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং দলের বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

শ্রদ্ধা জানান পূর্ব মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম,বাঁকুড়ার সিপিআইএম নেতৃত্ব। এদিন সকালে দীপক বাবুর বাসভবনে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন বিধায়ক সুজয় হাজরা, পুরপ্রধান সৌমেন খান, কাউন্সিল মৌ রায় প্রমুখ তৃণমূল নেতৃত্ব। সিপিআইএম জেলা অফিসে এসে শ্রদ্ধা জানান বিজেপি নেতা অরূপ দাস, কংগ্রেস নেতা দেবাশীষ ঘোষ,পংকজ পাত্র, এস ইউ সি আই নেতা অমল মাইতি, সিপিআইএমএল নেতা শৈলেন মাইতি, সিপিআই নেতা অশোক সেন, গিয়াসুদ্দিন, বিপ্লব ভট্ট, আর এস পি নেতা জয়ন্ত পাত্র, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা আনোয়ার রেজা সহ অন্যান্যরা। শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জয়ন্ত সাহা, সঙ্গীত শিল্পী আলোক বরণ মাইতি, চিকিৎসক ডাঃ বি বি মন্ডল, চিকিৎসক ডাঃ বিমল গুড়িয়া, ডাঃ সুদীপ চৌধুরী সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ।

বেলা দুটায় মরদেহ নিয়ে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্য শেষ যাত্রা শুরু হয় ৮৫ টি অর্ধনমিত লাল পতাকা, ইন্টারন্যাশনাল গানের দল সহ। সঙ্গীহন দলীয় নেতৃবৃন্দ, কর্মী, সমর্থক ও তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী। শেষ যাত্রা শেষে প্রয়াত দীপক সরকারের দেহ মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়।