পশ্চিম মেদিনীপুর সেখ ওয়ারেশ আলী : অলৌকিক মহিমা ও রহস্যে মোড়া এক দেবীস্থান।মেদিনীপুর শহরের হৃদয়ে, পদ্মাবতী মহাশ্মশানের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক শক্তির প্রতীক — উগ্রতারা মা, যিনি শহরবাসীর কাছে পরিচিত শ্মশানকালী মা নামে। পরাধীন ভারতের অন্ধকার সময়ে, এক অজানা ভিনদেশী সাধুবাবার হাত ধরে শুরু হয় এই পূজা। কে ছিলেন তিনি, আজও রহস্যই রয়ে গেছে। বলা হয়, তিনি হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে কথা বলতেন, আর তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ সেই সাধুবাবাই গড়ে তোলেন এই মন্দির। মন্দির কমিটির সদস্য জানান, “দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় এখানে ঘন জঙ্গল ছিল, সেখানেই সাধুবাবা তপস্যা শুরু করেন।” কিংবদন্তি বলে, বক্সীবাজারের এক তরুণীর অপঘাতে মৃত্যুর পর তাঁর হাড়গোড় ও খুলি দিয়ে মা উগ্রতারার মূর্তি গড়েছিলেন সাধুবাবা। রটন্তী চতুর্দশীর রাতে সেই পবিত্র সাধনাই হয়ে ওঠে দেবীর প্রতিষ্ঠা দিবস। বাংলার ১২৩৪ সনে, তান্ত্রিক পশুপতি মুখোপাধ্যায়ের তান্ত্রিক বিদ্যা দিয়ে তারা মায়ের পুজোর সূচনা হয়। প্রায় ১৫০-২০০ বছর ধরে সেই অস্থি দ্বারাই মায়ের মূর্তি তৈরি হয়েছে। প্রতি ১২ বছর অন্তর নবকলবরে এই মূর্তি বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি তৈরি হয়। পঞ্চমুণ্ডের আসনে বসে উগ্রতারা মায়ের পুজো করেন বর্তমান পুরোহিতরা ।পরবর্তী নবকলেবর অনুষ্ঠিত হবে ২০২৮ সালের রটন্তী চতুর্দশীতে। পুরোহিত দুর্গা শংকর মিশ্র বলেন, "এই কালী প্রতিমা মূলত তান্ত্রিক মতে হয় । এই পুজো দেওয়া হয় মায়ের প্রিয় খাবার শোল মাছ পোড়া । এছাড়াও এই প্রতিমার দুই পাশে তাঁর দুই সহচরী বিরাজমান সবসময় । মায়ের প্রতিমা তৈরি হয়েছে মৃত মানুষের অস্থি দ্বারা ।"

মন্দিরের পুরোহিত দুর্গাশঙ্কর মিশ্র এক অলৌকিক ঘটনার কথা স্মরণ করেন “এক সন্ধ্যায় এক অচেনা তরুণী এসে বলেছিলেন, ‘তুই কারও জন্য অপেক্ষা করবি না, সময়মতো আরতি করবি।’ এরপর দেখি, তিনি অদৃশ্য!” মন্দিরে আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন, সেই তরুণী ছিলেন মা উগ্রতারা স্বয়ং। পুরোহিত দুর্গা শংকর মিশ্র বলেন, "এই কালী প্রতিমা মূলত তান্ত্রিক মতে হয় । এই পুজো দেওয়া হয় মায়ের প্রিয় খাবার শোল মাছ পোড়া । এছাড়াও এই প্রতিমার দুই পাশে তাঁর দুই সহচরী বিরাজমান সবসময় । মায়ের প্রতিমা তৈরি হয়েছে মৃত মানুষের অস্থি দ্বারা ।"১২ বছর অন্তর নবকলেবরে প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হয় গান্ধি ঘাটে। সেই সময় শুধু অস্থি রেখে দেওয়া হয় ৷ সেই অস্থি দিয়ে আবার নতুন করে প্রতিমা তৈরি করা হয়। সেই সময় থেকেই নিয়ম ও বিধি মেনে মায়ের পুজো হয়ে আসছে এখানে ৷ এই কালীপুজোর বিশেষত্ব হল, পুজোয় মাকে ফলমূল-নৈবদ্যের সঙ্গে দেওয়া হয় শোলমাছ পোড়া ৷ কথিত আছে, শোলমাছ পোড়া নাকি মায়ের পছন্দের খাবার ৷ প্রথা অনুযায়ী এখানে পশুবলি হয় ৷ পাশাপাশি, প্রতিমার বিশেষত্ব হল, মায়ের দু'পাশে দুই সহচরী ডাকিনী ও যোগিনী সব সময় বিরাজমান নরমুণ্ড হাতে।বর্তমানে এখানে বলি প্রথা বন্ধ — দেবীর সামনে উৎসর্গ করা হয় লাউ, চালকুমড়ো, আর মায়ের নামে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ হয় অন্নভোগ। রটন্তী চতুর্দশীর রাতে হাজারো প্রদীপে আলোকিত হয় মহাতাবপুর; শ্মশানের নীরবতা ভেদ করে ভেসে আসে ঢাকের শব্দ, শঙ্খধ্বনি আর “জয় মা উগ্রতারা”র ধ্বনি।মেদিনীপুরের এই শ্মশানকালী মা কেবল এক দেবী নন — তিনি বিশ্বাস, শক্তি, আর ভক্তির এমন এক প্রতীক, যাঁর অলৌকিক উপস্থিতি আজও শহরের প্রতিটি হৃদয়ে অনুভূত হয়।