নিজস্ব সংবাদদাতা : পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন বন্দর শহর তাম্রলিপ্ত বা তমলুক।এখানেই রয়েছে দেবীর ৫১ সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ, দেবী বর্গভীমা মায়ের মন্দির। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ৫,০০০ বছরের পুরনো দেবী বর্গভীমা মন্দির । কালের করাল গর্ভে সবই আজ ভগ্নস্তূপ। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাসকে অস্বীকার করে যে কয়টি আজও বেঁচে আছে পূর্ণ মহিমায়। তার মধ্যে দেবী বর্গভীমা সর্বশ্রেষ্ঠ।

ইতিহাস আর কিংবদন্তী পেরিয়ে এ মন্দির আজ পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের উৎসবক্ষেত্র। এর শ্রেষ্ঠ পূজা শারদীয়া উত্সবে। দেবী বর্গভীমা তখন করালবদনা বরাভয়দায়িনী শক্তিরূপিনী ভীমা, আদ্যাশক্তি মহামায়া। সতীর ৫১ সতীপীঠের এক পীঠস্থান বর্গভীমা, বিভাস নামেও পরিচিত।সত্যি মায়ের বাম পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এখানে।দেবী কপালিনী (ভীমরুপ) ও ভৈরব সর্বানন্দ।এখানে মায়ের প্রত্যহ ভোগের ব্যবস্থা রয়েছে।অন্য জায়গার মতো এখানে পান্ডাদের দৌরাত্ম্য নেই বললেই চলে। ইতিহাসের কোন প্রাচীন অক্ষরেখা ধরে কে যেন বলে এ হল বৌদ্ধসংঘারাম। হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে শক্তির আরাধকরা একে রূপান্তরিত করেছে হিন্দু মন্দিরে।

যদি তাই হয়, সেও তো বল্লাল সেনের যুগ। কিংবদন্তী নিয়ে যায় আরো কোনো প্রাচীন কথায় পুরাকালে বর্গভীমার জন্য তাম্রলিপ্ত যে একটি বিশিষ্ট সিদ্ধপীঠ হিসেবে প্রকীর্তিত ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মপুরাণ থেকে। পুরাকালে দেবাদিদেব মহাদেব দক্ষযজ্ঞে ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতিকে নিহত করলে ব্রহ্মহত্যার ফলস্বরূপ শরীর বিশ্লিষ্ট দক্ষের মাথা মহাদেবের হাতে সংসৃষ্ট হয়ে যায়। মহাদেব কোনোপ্রকারেই একে নিজের হাত থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে পেরে উদ্দাম নৃত্য করতে থাকেন, তাতেও হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পেরে পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। কিন্ত্ত দক্ষের মাথা তাঁর হাত থেকে কিছুতেই বিশ্লিষ্ট না হওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে বিষ্ণুর নিকটে উপস্থিত হলেন। তখন বিষ্ণু বললেন :
অহং তে কথয়িষ্যামি যত্র নশ্যতি পাতকং
তত্র গত্বা ক্ষণামুক্তঃ পাপাদ্ধর্গো ভবিষ্যসি।।
অর্থাৎ সেখানে গমন করলে জীব ক্ষণকাল মধ্যে পাপ থেকে মুক্ত হয়, এবং সকল পাপ বিনষ্ট হয়, তোমায় সে স্থানের মাহাত্ম্য বলব। এই বলে বিষ্ণু বললেন :
আস্তি ভারতবর্ষস্য দক্ষিণস্যাং মহাপুরী,
তমোলিপ্তং সমাখ্যাতং গূঢ়ঃ তীর্থ বরং বসেত্।
তত্র স্নাত্বা চিরাদেব সম্যগেষ্যসি মত্পুরীং
জগাম তীর্থরাজস্য দর্শনার্থং মহাশয়।।

অর্থাৎ ভারতবর্ষের দক্ষিণে তমোলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) নামে মহাতীর্থ আছে, তাতে গূঢ়তীর্থ বাস করে। সেখানে স্নান করলে লোকে বৈকুন্ঠে গমন করে। অতএব আপনি তীর্থরাজের দর্শনের জন্য সেখানে যান। মহাদেব একথা ষুনেই তাম্রলিপ্ত হয়ে বর্গভীমা ও বিষ্ণু নারায়ণের মন্দির দুটির মধ্যবর্তী সরসীনীরে অবগাহন করলে দক্ষ শির তাঁর হাত থেকে মুক্ত হল। মহাভারতের যুগে নরপতি তাম্রধ্বজ এক ধীবরপত্নীর কাছ থেকে শোনেন আলৌকিক সে কাহিনী। রোজ মরা মাছ কয়েক যোজন দূর থেকে এনে বনের ভেতর এক মন্দিরের পুকুরে ডুবিয়ে সে মাছকে জ্যান্ত করে নেয়। তারপর নিয়ে যায় রাজবাটীতে। রাজা তাম্রধ্বজ সেই কাহিনী শুনে ধীরবীর সমভিব্যবহারে গিয়ে উপস্থিত হলেন বনের ভেতরের সেই মন্দিরে। প্রতিষ্ঠা করলেন দেবীকে-প্রস্তরময়ী সে দেবীকে স্বমহিমায়। ওড়িশি স্থাপত্যের আদলে বর্গভীমা মায়ের মন্দিরের দেউলের উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার অজস্র কাজ।

তার মধ্যেই মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরে তৈরি মায়ের মূর্তি বিরাজ করছে দেবী উগ্রতারা রূপে। পুরাণ উলেখ রয়েছে, দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত হয়ে তাঁর বাম পায়ের গোড়ালি এই স্থানে এসে পড়ে। আরও আনেক রকম ইতিহাস, কিংবদন্তী, প্রবাদ প্রচলিত আছে। সে থাক। এবার বরং আসি এখন মন্দিরে যা আছে, তার বর্ণনায়। বর্গভীমাকে আনেকে চন্ডীতন্ত্রে কথিত ভীমাদেবী বলে মনে করেন। ৫১ পীঠের মধ্যে তমলুকের বর্গভীমাও একটি পীঠস্থান। এই দেবীর মূর্তি একটি প্রস্তরের সম্মুখভাগ খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। এই মূর্তির গঠন উগ্রতারা মূর্তির মতই। প্রতিকৃতিটি কৃষ্ণ প্রস্তরে নির্মিত। এরকম খোদাই করা মূর্তি সচরাচর দেখা যায় না। এই দেবীর ধ্যান ও পূজাদি যোগিনী মন্ত্র ও নীল তন্ত্রানুসারে সম্পাদিত হয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমঙ্গল (অভয়ামঙ্গল) কাব্যে এই দেবী সম্পর্কে লিখেছেন :“গোকুলে গোমতীনামা তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা
উত্তরে বিদিত বিশ্বকায়া।”সেও তো প্রায় চারশ বছর আগের লেখা।বর্তমানে মন্দিরটির চারদিকে কিছু সংস্কার করা হলেও মূল প্রাচীন রূপটি অক্ষুন্ন। মন্দিরটি উচ্চতায় প্রায় 60 ফুট। এর দেওয়ালের ভেতরের প্রস্থ 9 ফুট। এটি গোল ছাদ বিশিষ্ট। মন্দিরের চারটি অংশ—(১) মূল মন্দির
(২) জগমোহন
(৩) যজ্ঞ মন্দির
(৪) নাট মন্দির।তবে মনে হয় মন্দিরটির সব অংশ একসঙ্গে তৈরি হয়নি।

আর সেই থেকেই একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ হিসাবে তমলুকে দেবী বর্গভীমা রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। তবে প্রাচীন এই মন্দিরের বয়স কত তা অনুমান করা বেশ মুশকিল। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেলীতে ২৭টি পোড়ামাটির বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। এ মন্দির রেখ দেউল রীতির। এখনকার রূপ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় এ মন্দির নির্মিত হয়েছে।

ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষ। এই চারটি বর্গ দান করেন বলেই মায়ের নাম দেবী বর্গভীমা। নীল তন্ত্র মতে মায়ের আরাধনা করা হয় এখানে। কালীপুজোর দিন রাজবেশে মাকে সাজিয়ে মহা ধুমধামে পুজো হয়। বছরের অন্য দিনগুলিতে মাকে ভোর চারটেয় স্নান করিয়ে স্বর্নালঙ্কারে সাজানো হয়। অন্নভোগে নানা ব্যঞ্জনের পাশাপাশি এখনও রোজ মাকে নিবেদন করা হয় শোল মাছের ঝোল। ভক্তরাও মাকে মিষ্টি ভোগের পাশাপাশি মনোবাঞ্ছা পূরণে তাল, ওল, কচু এবং শোল মাছ নিয়ে মন্দিরে হাজির হন। ভিন ধর্মের মানুষজনও আসেন এই মন্দিরে।