নিজস্ব প্রতিবেদন : খ্যাতিমান কথাশিল্পী সমরেশ বসু- এর শুভ জন্মদিন।সমরেশ বসু ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক। তার জন্মনাম সুরথনাথ বসু কিন্তু সমরেশ বসু নামেই লেখক পরিচিতি সমধিক। তিনি কালকূট ও ভ্রমর ছদ্মনামে উল্লেখযযোগ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৮০ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।মরেশ বসুর জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯২৪ বিক্রমপুর, ঢাকায়। তাঁর শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে ভারতের কলকাতার নৈহাটিতে। বাবার নাম মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবলিনী বসু। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। অতি দারিদ্রতার মধ্যে বড় হওয়া তাঁর ।মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতে হয়েছে তাঁকে। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক' (প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২-১৬ এপ্রিল ১৯৮৮)। লিখেছিলেন, 'তিনি আমাদের মতো অফিস-পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না, যাঁদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার। অথচ ষোল আনার ওপর আঠারো আনা শখ আছে লেখক হওয়ার।'১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের বন্দুক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়। জেলখানায় তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি ছিল তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধর্মী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে তিনি অমৃতের সন্ধান করেছেন। তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ অমৃত বিষের পাত্রে, মন মেরামতের আশায়, হারায়ে সেই মানুষে, তুষার শৃঙ্গের পদতলে ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস ।ভ্রমর ছদ্মনামে লেখা তিনটে উপন্যাস ১৩৮৯, ১৩৯০ ও ১৩৯১ বঙ্গাব্দের শারদীয়া প্রসাদএ প্রকাশিত হয়:'যুদ্ধের শেষ সেনাপতি' , 'প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত' , 'প্রেম - কাব্য - রক্ত'।লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন, তাঁর কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁরই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনি গোয়েন্দা গোগোল ও গোগোলের কীর্তি নামে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে।সমরেশ বসুর উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় শতকের ঘরে। উল্খেযোগ্য- উত্তরঙ্গ, গঙ্গা, বিবরপ্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে, সওদাগর,কোথায় পাবো তারে, নয়নপুরের মাটি, বাঘিনী, চলো মন রুপনগরে, পাতক, মুক্তবেণীর উজানে , টানাপোড়েন, স্বীকারোক্তি, অপদার্থ, সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা, যুগ যুগ জীয়ে, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, বাঘিনীবিপর্যস্ত, শাম্ব, বিটি রোডের ধারে, শ্রীমতি কাফে, অবশেষে, আম মাহাতো, কামনা বাসনা, কে নেবে মোরে, খন্ডিতা, গোগোল চিক্কুস নাগাল্যান্ড, ছায়া ঢাকা মন,জঙ্গল মহলের গোগোল, জবাব, তিন পুরুষ, দাহ, নাটের গুরুনিঠুর দরদী,পথিক, প্রাণ প্রতিমা, বিদেশী গাড়িতে বিপদ, ভানুমতী ও ভানুমতীর নবরঙ্গ,মহাকালের রথের ঘোড়া, রক্তিম বসন্তশিমুলগড়ের খুনে ভূত, শেখল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, সেই গাড়ির খোঁজে, স্বর্ণচঞ্চু,হৃদয়ের মুখ, প্রচেতোষ প্রমুখ। তাঁর প্রকাশিত ছোটগল্পের সংখ্যা ২০০ কাছাকাছি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সমরেশ বসু এক দুঃসাহসিক প্রথাবিরোধী লেখকের নাম।তার স্বাতন্ত্র গদ্যশৈলী তাকে বাংলা কথাসাহিত্যে ব্যতিক্রমী আসন দিয়েছে। প্রচলিত গদ্যরীতিকে ভেঙে চুরমার করে এমন নূতন এক গদ্যের জন্ম দিয়েছেন যা যেকোনো সাহিত্যিকের থেকে সমরেশকে আলাদা করেছে।এই প্রসঙ্গে প্রজাপতি’র কথা ধরা যাক। অথবা বিবর বা ধরা যাক অপদার্থ।সমরেশের ‘পাতক’, ‘প্রজাপতি’,‘ বিবর’,‘ স্বীকারোক্তি’, ‘অপদার্থ’ এ পাঁচটি উপন্যাস সম্পর্কে বার বার অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে। এ উপন্যাসগুলো যারা পড়েছেন তারা জানেন দুঃসাহসিক কাহিনীর প্রয়োজনেই এসব উপন্যাসে কিছুটা বিতর্কিত বিষয় সমূহের আগমন ঘটেছে। কিন্তু এসব উপন্যাসে ওইসকল বিষয়সমূহ কখনও কাহিনীকে অতিক্রম করেনি।বাংলাসাহিত্যে এখন পর্যন্ত একটি উপন্যাসেরই নাম করা যায় যেটি নিম্ন আদালত কর্তৃক অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দীর্ঘ ১৭ বছর পর মুক্তি পায়। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’র কথা বলছি। ইতোমধ্যে বইটি এক ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে।কথিত অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হলেও বইটির প্রধান বৈশিষ্ঠ্য এর ব্যতিক্রমী গদ্যশৈলী। ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের (মতানৈক্যে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ) ‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যায় যখন নাতিদীর্ঘ এ উপন্যাসটি বেরোয় সমসাময়িককালে কিংবা তারও আগে এরকম উজ্জ্বল গদ্যের উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই।