দোল উৎসবের দিন এখনো, এত বছর পরে বিস্মৃতির অতল গভীর থেকে ভেসে ওঠে একটা মুখ।
রোজকার জীবন সংগ্রামে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, শুকনো একটা মুখ।কপালে ঝুলে পড়েছে কাঁচা, পাকা এলোমেলো চুল। সিঁথির চওড়া সিঁদুর ঘামে ভিজে নেমে এসেছে কপালে। অসময়ের বলিরেখা কপালে, গালে, চোখের চারপাশে।
ঢুকে যাওয়া চোখের নীচে কালি মাখা। কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন, আন্তরিক, বিনয়ী।
সরল, স্বচ্ছ হাসিটি মুখে লেগেই থাকত গ্রাম্য, ঘরোয়া, মধ্যবয়সী মুখটিতে। মুখটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেক মায়াময় সুখের স্মৃতি। আজ দোল পূর্ণিমার শুভ দিনে স্মৃতির আয়নায় ঝলসে উঠছে সেইসব পুরাতন কথা।
সব যেন সদ্য ঘটা ঘটনার মতো স্বচ্ছ, স্পষ্ট, উজ্জ্বল।
চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,
আমরা ছোট বড় মিলিয়ে সাত- আট জন মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।সামনে কৃষ্ণ রাধার মূর্তি। ফুলে ফুলে সজ্জিত, আচ্ছাদিত। চন্দন ধূপের অপূর্ব সুগন্ধে ম ম করছে মন্দির চত্বর।
মন্দিরের দুই পাশে দুটি গাছ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া অজস্র ফুলের সম্ভারে হেলে পড়েছে। কৃষ্ণচূড়া সেজেছে লাল আবিরে আর রাধাচূড়া সেজেছে হলুদ আবিরে।
গাছগুলি যেন মাথায়, মুখে প্রচুর লাল, হলুদ আবির মেখে দোল উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার অংশীদার হয়েছে।
আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ আটকে আছে একটু দূরে বড় লম্বা, ঝাঁকড়া, বহু পুরাতন বট গাছটার মাথার উপরে। দোল পূর্ণিমার পুজো হচ্ছে গ্রামের সবচেয়ে পুরাতন মন্দিরটিতে।
গ্রামের কতো লোক জড়ো হয়েছে মন্দিরের সামনে। আবাল- বৃদ্ধ- বনিতা সবাই। মন্দিরের পাশে একটা ছোট্ট গ্রাম্য মেলা বসেছে।
পুজো দেখে আমরা ওই মেলা ঘুরতে গেলাম। আমরা মানে আমরা পাশাপাশি যে তিনটি বাড়িতে থাকি, সেই বাড়ির কাকিমা, জ্যাঠাইমা, মা আর তাদের ছানা পোনারা। এই তিন বাড়িতে ঠিকা পরিচিকার কাজ করত পদ্ম মাসি। প্রত্যেক বছর দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা আমরা পদ্ম মাসির বাড়ি বেড়াতে আসি। পারুলিয়া গ্রামে দোলের পূজা আশেপাশের গ্রামে খুবই বিখ্যাত। প্রচুর লোক জমায়েত হয়, মন্দির ও মেলা প্রাঙ্গনে।
প্রত্যেক বছরই মাসি আমাদের অনেকবার অনুরোধ করে তাদের বাড়ি যাবার জন্য। দোলের পুজো দেখার জন্য। আমরা এবারেও পারিনি তার অনুরোধ ঠেলতে।
মন্দিরের পুজো দেখে , মেলায় ঘুরে ,মায়েদের সেখানে অল্প কিছু কেনাকাটার পরে আমরা শেষে পদ্ম মাসির বাড়ি উপস্থিত হলাম।
মাসি আমাদের জন্য হা পিত্যেশ করে উঠোনে বসে অপেক্ষা করছিল। পদ্ম মাসির ছোট্ট মাটির বাড়ি। তিনটি ঘর পাশাপাশি।
কেমন পরিষ্কার, ঝকঝকে, তকতকে। গোবর দিয়ে যত্ন করে নিকোনো , চালের গুঁড়ি দিয়ে আঁকা আল্পনা, দেওয়ালে ধানের ছড়া ঝোলানো উঠোনে মাসি আমাদের , ছোটদের বসতে দিল মাদুর বিছিয়ে। আমরা , কচি কাঁচারা হৈ হৈ করে বসে পড়লাম মাদুরের উপরে। আর মায়েরা বসল ঘরের ভিতরে তক্তপোষে।
ওদের গল্পের আওয়াজ, হাসির আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল। উঠোনের সামনে মাচায় লতিয়ে ওঠা পুঁই শাকের আর কুমড়ো গাছের চারা তখন চাঁদের আলোয় চক চক করছে।
খুব স্বল্প, সাধারণ আয়োজন, কিন্তু সবকিছুর মধ্যে কেমন চমৎকার শ্রী ফুটে বেরোচ্ছে ।
আমরা বাইরে উঠোনে পেতে দেওয়া মাদুরের উপর বসে মাসির বের করে দেওয়া লুডো নিয়ে খেলায় মেতে উঠলাম। খানিকক্ষণ পরে মাসি তার হাতের তৈরী গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারী করে আনল।
সঙ্গে ঘরের নারকেল গাছের পাড়া নারকেলের নাড়ু আর মুড়ির মোয়া। তার স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। মাসি যে কিভাবে আমাদের আদর, আপ্যায়ন করবে, বুঝে উঠতে পারতোনা।
যেন মনে হত কোনো রাজার বাড়ি থেকে আমরা তার দরিদ্র কুঁড়ে ঘরে হাজির হয়েছি। মাসি এত ব্যস্ত হয়ে উঠত যে মা, কাকিমাদের কাছে বকুনি , ধমকানি খেত। মা তো বলেই বসল, জয়ার মা, অত বাড়াবাড়ি করার কি আছে! আমরা এসেছি তো কি হয়েছে? তুমি যেমন পারবে, সেইরকম ভাবে আদর, আপ্যায়ন করবে। আমরা কেউ কিচ্ছুটি মনে করবোনা গো!
তবু কি মাসি শোনে! বলে উঠল, সোনারা! আমার ঘরের ছাগলের দুধ খাবা? গরম করে আনি। একটু পরেই দুধ গরম করে মাসি ঘটিতে করে নিয়ে এল। আমাদের পাঁচজন বাচ্ছাদের ছোট ছোট স্টিলের গ্লাসে সেই দুধ ঢেলে দিল।সেই প্রথম ছাগলের দুধ খাওয়ার অভিজ্ঞতা । ঘন, গাঢ় দুধ বেশ ভালই লেগেছিল।বেশ মিষ্টি লেগেছিল। মাসির পোষা হাঁসের ডিমও সিদ্ধ করে সবাইকে খাইয়েছিল। সেইসব খাবারের স্বাদ, গন্ধ আজ এত বছর পরে স্মৃতিতে ফিরে আসে বারংবার।
সেই হৃদয় নিংড়ানো , অমলিন , নির্মল আন্তরিকতা কি ভোলার?
তা ভুলে যাবার নয়। আজো , এখনো , এত বছর পরে দোল উৎসবের দিন , পদ্ম মাসির সেই আন্তরিক, দরদ ভরা কণ্ঠ কানে বাজে বারংবার, খুকী, নারকেল নাড়ু খাবা?
মুড়ির মোয়া নেবানা?