Skip to content

বাংলাদেশে ভয়ংকর 'আয়নাঘর' এক দুঃস্বপ্নের নাম!

ঢাকা, জাকির হোসেন: ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। এ সময় নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে শেখ হাসিনা সরকারের গোপন বন্দিশালা আয়নাঘরের কাহিনি। গোপন এই সেনার কুঠুরিতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতেন রাজবন্দিরা। মাটির নিচে এই কারাগার। সেখানেই ‘হাসিনা বিরোধী’ অনেককেই দমন করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। নির্যাতন সইতে না পেরে আয়নাঘরের কোনো কোনো বন্দি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। কেউ বা বরণ করেছেন মৃত্যুকে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই বন্দিশালা থেকে ছাড়া পেয়েছেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রীর আক্রোশের শিকার হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসকে। যাঁরা সেখানে গিয়েছেন তাঁদের কাছে আয়নাঘরে থাকা একটা ‘দুঃস্বপ্ন’। তাঁরা জানিয়েছেন, আন্ডারগ্রাউন্ড জেলের জানালাহীন প্রকোষ্ঠে তাঁদের দীর্ঘ দিন থাকতে হয়েছিল। সেখানে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় হাত এবং চোখ বেঁধে। যখন তাঁদের ছাড়া হয়েছে, তখনও একই ভাবে নিয়ে আসা হয়। যাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁদের সবাই ভেবেছিলেন সেই অন্ধকার থেকে তাঁদের যেন মুক্তি হবে না। তাঁদের অভিযোগ, হাসিনার বিরোধিতা যাঁরা করেছিলেন তাঁদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে এবং বাকিদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিটারি ডিটেনশন সেন্টারে‘ রাখা হয়েছিল। সেই কারাগারেরই কোড-নাম ছিল 'হাউস অফ মিররস' বা 'আয়নাঘর'। এখন সেখানের অনেকেই সেই গোপন ডেরার গল্প প্রকাশ্যে এনেছেন। তাঁরা যে কথা সামনে এনেছেন তা একটি নির্মম ইতিহাস। তাঁদের দাবি, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী বন্দিদের আটকে রাখার ভার ন্যস্ত হয়েছিল সামরিক গোয়েন্দা শাখার (ডিজিএফআই) উপর। মানবাধিকার সংস্থাগুলির দাবি, ২০০৯ থেকে হাসিনা সরকারের পতন হওয়া অবধি ৭০০ জনেরও বেশি লোককে জোর করে ‘গুম করা হয়েছে’। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, আয়নাঘরে যাঁরা কাটিয়ে এসেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে তাঁদের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। মাটির নিচের ঘরের একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে যারা বাইরের আলো দেখার চেষ্টা করেছেন তাঁদের ভোগ করতে হয়েছে আরও যন্ত্রণা। তাঁরা জানান, আয়নাঘরের লক্ষ্য ছিল বন্দিদের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা। সেখানে কেউ কারোর সঙ্গে কথাও বলতে পারতেন না। তাঁদের একজন বলেন, ‘এমন কোনও ভাষা নেই যা দিয়ে আমি আমার অপমান ও যন্ত্রণা বর্ণনা করতে পারব।’ যদিও কাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুসারে, আগস্ট মাসে হাসিনা দেশ ছাড়ার পরেই প্রকাশ্যে আসেন মীর আহমদ কাসেম আরমান এবং আরও দুইজন ব্যক্তি। তাঁরা দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন ওই গোপন কারাগারে। পেশায় আইনজীবী আরমান, মুক্তি পাওয়ার পরে জানিয়েছেন, তিনি যেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শুধুমাত্র একবার দেখা করতে পারেন সেই প্রার্থনাই করতেন। আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া বহু মানুষ দাবি করেছেন, যে ভূগর্ভস্থ কক্ষে তাদের রাখা হত তার ওপর সকালে সামরিক কুচকাওয়াজের শব্দ শোনা যেত। বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ছিলেন সেই বন্দিদের এক জন৷ জামান জানান, তিনি ৪৬৭ দিন বন্দি ছিলেন আয়নাঘরে। মারুফ একসময়ে কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, ঢাকার সামরিক গ্যারিসনে অবস্থিত এই আয়নাঘর। জামান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর মাথা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো এবং মুখে বারবার ঘুষি মারা হতো। তাঁকে তাঁর সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ব্লগে পোস্ট করা লেখাগুলোর কপি দেখানো হতো এবং নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করা হতো৷ আয়নাঘরের আরেক বন্দি ছিলেন প্রাক্তন উচ্চপদস্থ সেনা আধিকারিক আবদুল্লাহিল আমান আজমি৷ আট বছর বন্দি ছিলেন৷ আজমির অনুমান, ওই কয়েক বছরে অন্তত ৪১ হাজার বার তাঁর চোখ বাঁধা হয়েছে এবং হাতকড়া পরানো হয়েছে। আয়নাঘরে বিরামহীন যন্ত্রণা ভোগের বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, ‘আমি সৃষ্টিকর্তার আকাশ, সূর্য, ঘাস, চাঁদ, গাছ দেখিনি। সেখানে আমি যে অপমান এবং বেদনা অনুভব করেছি তা ব্যাখ্যা করতে পারব তার ভাষা নেই।’ প্রাক্তন এই সেনা আধিকারিক জানান, বন্দি অবস্থায় তিনি মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন।

Latest