বেশ কয়েক বছর ধরে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার্থে বাংলা ছেড়ে ভিনরাজ্যে পড়তে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভিনরাজ্যে পড়তে যাওয়া এই পড়ুয়াদের টার্গেট করেই শুরু হয়েছে অভিনব কায়দায় প্রতারণা। এতে পড়ুয়া ও অভিভাবকরা সর্বস্ব হারানোর সম্ভাবনার মুখে পড়ছেন। একই ঘটনা ঘটেছে আমার সঙ্গেও। সম্প্রতি এক সকালে আমার মোবাইল ফোনে একটি হোয়্যাটসঅ্যাপ কল আসে। ব্যস্ততার কারণে যাচাই না করেই কলটি ধরে ফেলি। ফোনের ও প্রান্ত থেকে হিন্দিতে প্রশ্ন করা হয়, আমি কি ‘অমুক’? আমার ছেলে কি চণ্ডীগড় ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলায়, নিজেকে পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দিয়ে সেই ব্যক্তি জানান, “...পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনার ছেলের সঙ্গে আরও তিনটি ছেলে গুরুতর অপরাধের কারণে এখন পুলিশ হেফাজতে। যে-হেতু আপনার ছেলে পড়াশোনায় ভাল, তাই জামিন হয়ে যাবে। তবে কিছু টাকা পাঠাতে হবে।” ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলা হয়, ছেলে লকআপে থাকায় কথা বলা যাবে না। আচমকা এমন দুঃসংবাদে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ফোনটাও কেটে যায়। দশ মিনিট পরে আবার আমাকে ফোন করে বলা হয়, ফোনটা কেটে দেওয়া হল কেন? একটা নম্বর পাঠানো হচ্ছে, এখনই টাকাটা পাঠিয়ে দিতে। না হলে আমার ছেলে ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। আমি ফোন কেটে দিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে, ছেলের সঙ্গে কলেজে যোগাযোগ করি। ছেলে তখন পরীক্ষার হলে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাই। তত ক্ষণে মোবাইল থেকে প্রতারকদের সমস্ত তথ্যও উধাও।
পরে, ঠান্ডা মাথায় মনে হয়েছে, এমন গুরুতর কিছু ঘটলে কলেজ কর্তৃপক্ষই আগে বাড়িতে জানাবে। দুর্জনদের যেমন ছলের অভাব নেই, তেমনই প্রতারকদেরও নতুন নতুন প্রতারণা-ভাবনায় ঘাটতি নেই। আধুনিক প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে বিশ্ব জুড়ে প্রতারণার বহুবিধ ফাঁদ পাতা হচ্ছে প্রতি দিন। সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়— সতর্কতা ও উপস্থিত বুদ্ধি। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়— এরা পড়ুয়া ও অভিভাবকদের সমস্ত তথ্য নির্ভুল ভাবে পায় কী ভাবে?
ডিজিটাল জমানায় অনলাইনে বিনোদন বা নাগরিক পরিষেবার বহর যত বাড়ছে, ততই কমছে সাধারণ মানুষের আর্থিক সুরক্ষা সংক্রান্ত নিরাপত্তা। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, সারা দেশের বিভিন্ন শহরে যতবার সাইবার প্রতারণার জাল বিছানো হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কলকাতা। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাস, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই শহরে প্রায় ৭১ লক্ষ বার সাইবার প্রতারণার জাল বিছানো হয়েছে। তাতে কেউ পা দিয়েছেন, কেউ দেননি। সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই তিন মাসে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ১০ লক্ষ বার সাইবার প্রতারণার ফন্দি আঁটা হয়েছে।
একটা সময় ছিল, যখন গ্রাহককে ফোন করে নানা অছিলায় তাঁর ডেবিট কার্ডের গোপন তথ্য চাওয়া হতো। নেওয়া হতো পিনও। কিছুক্ষণ পর গ্রাহক দেখতেন, তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে উবে যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা। সেই পুরনো পদ্ধতিতে টাকা লোপাট এখনও হয় বটে, তবে আরও নতুন নতুন ফন্দিতে শুরু হয়েছে প্রতারণা পর্ব। প্রায় প্রতিদিনই নতুন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে এবং সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। সেই কাজে সবচেয়ে জোরালো টার্গেট যে কলকাতা, সেটাই জানাচ্ছে সমীক্ষা। সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কুইক হিল টেকনোলজিস লিমিটেড গোটা দেশে একটি সমীক্ষা চালায়, যেখানে তাদের মূল আগ্রহ ছিল, কোথায় কত সাইবার সংক্রান্ত প্রতারণা হচ্ছে, তা জানা। সেই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মুম্বইকে হারিয়ে একেবারে সামনের সারিতে চলে এসেছে কলকাতা। তারপর জায়গা করে নিয়েছে যথাক্রমে পুনে ও দিল্লি। সাইবার প্রতারণার জাল বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে শহরগুলিতে, তার সেরা দশে শেষের দিকে আছে চেন্নাইয়ের মতো মেট্রো শহর। তার স্থান নবম।
সমীক্ষাটি বলছে, মানুষ সচেতন হওয়ায় প্রতারকরা প্রতিদিনই নয়া কৌশল আমদানি করছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা হচ্ছে অনলাইন গেমিং অ্যাপগুলিকে কেন্দ্র করে। সমীক্ষা জানাচ্ছে, অ্যাপগুলিতে এমন কিছু খুদে বিজ্ঞাপন আসছে, যেগুলি মোবাইলের অন্য অ্যাপগুলিকে প্রভাবিত করছে। এমন কিছু অচেনা ‘ডোমেন’ থেকে আরও নানান লিঙ্ক আসছে, যেগুলির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই লুকিয়ে থাকছে সাইবার প্রতারণার হাতছানি। সাধারণ মানুষ সেসব বিষয়ে যদি বিশেষ কিছু না জানেন, তাহলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকী সেসব লিঙ্কে ক্লিক করে টাকা খোয়া যাচ্ছে বহু মানুষের।