নিজস্ব প্রতিবেদন: লোকনাথ বাবা ব্রহ্মচারী (জন্ম: ১৭৩০ - মৃত্যু: ১৮৯০) ছিলেন একজন হিন্দু সিদ্ধপুরুষ। তিনি বাবা লোকনাথ নামেও পরিচিত। হিন্দুধর্মানুশারীদের নিকট বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী অত্যন্ত পূজনীয় ব্যাক্তিত্ব।বাবার জন্ম তারিখ টি কিন্তু একটি বিশেষ দিন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর জন্মতিথি অর্থাৎ জন্মাষ্টমী। বাবা লোকেনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থভূমি। বিশেষত বাঙালি হিন্দুর কাছে এটি একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী বাজারের পশ্চিম-উত্তর কোণে বাবা লোকনাথ বাবা ব্রহ্মচারীর আশ্রম অবস্থিত। ঢাকা থেকে ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক পথ ধরে গিয়ে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।প্রতি বছর ১৯ জৈষ্ঠ্য এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মহাপুরুষ লোকনাথ বাবা ব্রহ্মচারীর তিরোধান উৎসব পালিত হয়। ১৮৯০ সালের (বাংলা ১২৯৭ সন) এই দিনে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেন। তার এই মহাকাল প্রয়াণের দিনটিকে ভক্তি এবং শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে স্মরণ করার জন্যই এই উৎসব ও মেলার আয়োজন হয়। এই তিরোধান উৎসবে অংশগ্রহণ করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাসহ দেশের লক্ষাধিক লোকনাথ ভক্ত বারদী আশ্রমে এসে সমবেত হন। জৈষ্ঠ্যের ১৯ তারিখ আশ্রমের চৌচালা ছাদের উপর থেকে ভক্তদের ছুঁড়ে দেয়া বাতাসা মিষ্টান্ন ও তা কুড়ানোর উচ্ছল আয়োজন হয় যা “হরি লুট” নামে পরিচিত। এছাড়া দিন ব্যাপী চলে গীতা পাঠ, বাল্যভোগ,বাবা লোকনাথের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ, রাজভোগ, প্রসাদ বিতরণ ও আরতি কীর্তনসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান। বারদীর বাবা লোকনাথ আশ্রম এখন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থানই নয়, বরং ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল ধর্মের, সকল মানুষের কাছে এক মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান উৎসবে সপ্তাহ ব্যাপী মেলা বসে। আশ্রমের ঠিক সামনে বিশাল সবুজ মাঠ। এখানেই মেলা বসে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়োজন করা হয় এখানে। নানান এলাকা থেকে হাজারও পণ্য আসে। আসে বাহারী তৈজসপত্র, আহারের ফল ফলাদি আরো কত কী। বহুদেশে বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের আগমন ঘটে এই মেলায়। এ এক বিশাল আয়োজন। এক সপ্তাহব্যপী চলতে থাকে রাতদিন।শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের দক্ষিণের উঠানে তাঁর সমাধিস্থলের পশ্চিমে শত বৎসর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির একটি বকুল গাছ। আশ্রমের ভেতরে আছে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিশাল তৈলচিত্র। মূল আশ্রমের পেছনে খোলা উঠান পেরিয়ে বিশাল পাঁচতলা ভবনের যাত্রীনিবাস। পশ্চিমে আরও দুটি বিশালাকার যাত্রীনিবাস। ভক্ত ও দর্শণার্থীরা বিনা পয়সায় এখানে রাত্রিযাপন করেন। সাধক পুরুষ লোকনাথ বাবা ব্রহ্মচারী জীবিত থাকা অবস্থায় আশ্রমের পাশে কামনা সাগর ও জিয়স নামে পুকুর খনন করা হয়। এই পুকুরটিতে আশ্রমে আগত ভক্তরা স্নান করেন।গৃহ ত্যাগের পর বাংলা ১১৪৮ সনে আচার্য গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে আসেন কালীঘাটের শক্তিপীঠে। একান্ন পিঠের অন্যতম মহাপীঠ কালীঘাট। তৎকালে কালীঘাট ছিল ঘন জঙ্গলময়। কালীঘাটে আসার পর বাল্য ব্রহ্মচারীদ্বয় আচার্যকে সাধন-ভজন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। সাধন-ভজনের জন্য নির্জন স্থানের উদ্দেশ্যে তারা কালীঘাট ত্যাগ করেন। নির্জন স্থানে এসে শিষ্যদ্বয় কঠোর সংযম পালন করেন এবং দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর নক্ত-ব্রত (দিনে অনাহারী থেকে রাত্রে আহার) ধারণ করেন। এরপর একান্তরা-ব্রত (একদিন উপবাসের পর দিন আহার), ত্রিরাত্রি, পঞ্চহ, নবরাত্রি ব্রত পালন করে করেন। আচার্য গাঙ্গুলী তাদের ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধলাভের জন্য তারা হিমালয়ের বরফাবৃত এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কঠিন তপস্যা দ্বারা লোকনাথ সমাধির উচ্চতম শিখরে পৌছান এবং পরমতত্ত্ব লাভ করেন। তখন তার বয়স ৯০ বছর।শিষ্যদের সিদ্ধি লাভের পর ভগবান গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে মক্কা দর্শনের অভিলাস করেন। তারা পায়ে হেঁটে রওনা হলেন মক্কার উদ্দেশ্যে। প্রথমে তারা উপস্থিত হলেন কাবুলে। সেখানে ‘মোল্লা সাদি’ নামে একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ধার্মিক মুসলমানের সাথে তাদের পরিচয় হয়। তার সাথে কুরআন ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ে নানা আলোচনা হয়। এখানে বাবা লোকনাথ কোরআন শিক্ষা করেছিলেন। তারা উপলব্ধি করলেন, বাহ্যিক আচার-আচরণ ছাড়া দুই ধর্মের মাঝে প্রভেদ নেই। কাবুলের পর তারা আসেন মদিনায়। এখানেও বেদ ও কুরআন নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা হয়। এখান থেকে তারা মক্কার পথে যাত্রা করেন। যাত্রা পথে ‘আব্দুল গফুর’ নামে ৪০০ বছর বয়সী এক উচ্চস্তরের মুসলমান ফকিরের দর্শনের জন্য তাঁর আস্থানায় যান। তিনি সবসময় মৌন এবং সমাধি অবস্থায় থাকতেন। সিদ্ধপুরুষ লোকনাথকে দেখে তার সমাধি ভঙ্গ হয় এবং তাকে আলিঙ্গন করেন। এরপর দুর্গম পথ অতিক্রম করে তারা মক্কায় পৌছান।মক্কায় কয়েকদিন অবস্থানের পর তাঁরা বারাণসীর কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে মহাযোগী ত্রৈলঙ্গস্বামীর পর্ণকুটির অবস্থিত। বৃদ্ধ গাঙ্গুলী তার শিষ্যদ্বয়ের সমস্ত দায়িত্ব ত্রৈলঙ্গস্বামীর হাতে তুলে দিয়ে গঙ্গার তীরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মহাপ্রস্থান হন। ত্রৈলঙ্গস্বামী মূলত পণ্ডিত হিতলাল মিশ্র। সেখানে স্বামীজীর সাথে তাঁরা কিছুকাল যোগশিক্ষা করে ভ্রমণে বের হন।ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তারা ভারতের পশ্চিমে আফগানিস্তান, আরব, ইসরায়েল, পারস্য, ইউরোপ ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। এরপরে তারা ভারতে ফিরে পুনরায় উত্তরের পথে গমন করেন। তারা বরফাচ্ছন্ন সুমেরু এলাকা গমনের ইচ্ছায় প্রাক-প্রস্তুতি উপলক্ষে শৈত্যপ্রধান এলাকা হিসেবে বদ্রীনাথ শ্রীমন্দিরের আশ্রমে অবস্থান করেন। সেখান থেকে আধুনিক পরিজ্ঞাত সীমা অতিক্রম করে উত্তরে বহুদূরে চলে যান। তারা হেঁটে হেঁটে সাইবেরিয়াতে চলে আসেন। সেখানে সূর্যোদয় না হওয়ায় সময় নির্ণয় করা যায় নাই; তবে তারা সে পথে ২০ বার বরফ পড়তে ও গলতে দেখেছিলেন। কয়েকটি বরফের স্তম্ভের কাছে এসে তারা যাত্রা সমাপ্ত করলেন। এরপর পূর্ব দিকে গমন করে চীন দেশে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ত্রৈলঙ্গস্বামী উদায়াচলের পথে যাত্রা করেন। বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব তিব্বত ও বদ্রীনাথ পাহাড়ে অবস্থান করলেন। তারপর বেণীমাধব কামাখ্যার উদ্দেশ্যে চলে যান এবং লোকনাথ বাবা চলেন চন্দ্রনাথ পহাড় সংলগ্ন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাত্রাকালে হঠাৎ জঙ্গলে আগুন লেগে যায়। তিনি লক্ষ করলেন বৃক্ষতলায় এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন আছেন। তিনি যোগবলে তাকে নিরাপদে নিয়ে আসেন। ইনি ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। এরপর লোকনাথ বাবা ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে আসেন। বারদী গ্রামের ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক ব্যাক্তি সেসময় ফৌজদারী মামলার আসামি হয়ে দাউদকান্দিতে ছিল। উদভ্রান্ত ডেঙ্গু কর্মকার বাবা লোকনাথকে দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। তখন লোকনাথ বাবা তাকে নির্ভয়ে থাকতে বলেন। পরদিন বিচারপতি ডেঙ্গুকে বেকসুর খালাস রায়ে দেন।বাবা লোকনাথকে ডেঙ্গু তার বাড়িতে নিয়ে আসেন।ডেঙ্গুর মৃত্যুর পর বারদ্রীর জমিদার তাকে নিয়ে আসেন জমিদার বাড়িতে। জমিদার তাকে ‘ছাওয়াল বাঘিনী’ নদীর তীরে একটি নিষ্কর শ্মশানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দেন। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেন। সে সময় থেকেই “বারদী’র ব্রহ্মচারী” হিসেবে লোকনাথ বাবা পরিচিতি পান।রদী অবস্থান কালে ভক্তগণ কৃপার জন্য তার নিকট আসতেন। এক ভক্ত তার পুত্রের দুরারোগ্য যক্ষ্মার মুক্তির জন্য তার নিকট আসেন। লোকনাথ বুঝতে পারেন সেই পুত্রের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। তবুও ভক্তকে কৃপা করে যক্ষ্মা রোগ নিজ শরীরে গ্রহণ করেন। পুত্র ধিরে ধিরে রোগ মুক্ত হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্য হয়। কিন্তু যক্ষ্মা রোগ লোকনাথের শরীরে ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। এরপর ১৯ জৈষ্ঠ্য তিনি তার দেহত্যাগের ঘোষণা দেন। এই সংবাদ পেয়ে ভারাক্রান্ত ও অশ্রুসিক্ত ভক্তগণ দলে দলে আসতে থাকে বারদীর আশ্রমে। সেখানে তিনি সবাইকে প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন।এসময় তার বয়স ছিল ১৬০ বছর।বাবার অভয় বাণী হলো..... "রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও, আমিই রক্ষা করিব" । "আমার বিনাশ নেই, শ্রাদ্ধও নেই, আমি নিত্য পদার্থ।
অর্থাৎ এই ‘আমি’ হলাম গীতায় বর্ণিত ‘পরমাত্মা’।""দেখ-অর্থ উপার্জন করা , তা রক্ষা করা, আর তা ব্যয় করবার সময় বিষয় দু:খ ভোগ করতে হয়। অর্থ সকল অবস্থাতেই মানুষকে কষ্ট দেয়। তাই অর্থ ব্যয় হলে বা চুরি হলে তার জন্যে চিন্তা করে কোন লাভই হয় না।""গরজ করবি, কিন্তু আহাম্মক (নির্বোধ) হবি না। ক্রোধ করিব কিন্তু ক্রোধান্ধ হবি না।""আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর।""যৎ তে কল্যাণরূপং তৎ তে পশ্যামি।।" "প্রতিদিন কার্যসিদ্ধি সমাপ্ত করার পর ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভেবে নিবি সারাদিন কি কি করেছিস। কোনটা ভালো কাজ, কোনটা খারাপ কাজ- তার হিসাব করবি। যদি এসব খারাপ কাজ ছেড়ে দিস,তাহলে দেখবি তুই পাপ কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবি।"
