ইতিহাস ও প্রাচীনতার মেলবন্ধন পশ্চিম মেদিনীপুরের কর্ণগড়। শালবনীর কর্ণগড়ের প্রাচীন ঐতিহাসিক মা মহামায়ার মন্দির । সেখানে মন্দিরে রয়েছেন প্রাচীন দেবীর বিগ্রহ আর ইতিহাস সম্বলিত কাহিনী। কর্ণগড়ের রাজা অজিত সিং -এর মৃত্যুর পর ছোট রাণী, শিরোমণি রাজত্ব পরিচালনা করতেন।তখনকার সময়ে জমিদারদের অধিনস্ত পাইকরা নিষ্কর্মা জমি নিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন এবং প্রয়োজনে জমিদারের কাজে সাহায্য করতেন। ইংরেজদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হলে পাইকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। অনেক রাজা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন কিন্তু রাণী শিরোমণি তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য । তিনি প্রজাদের কাছে ছিলেন দেবী সরূপা। তৎকালীন চূয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী হিসাবে তিনি উল্লেখ্য। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব দেন কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। রাণীর মৃত্যুর সত্য কাহিনী ইতিহাসবিদদের নানান মতের বন্ধনে আবদ্ধ। এই বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন যশোবন্ত সিংহ। শৌর্য আর প্রজাবাৎসল্যের কারণে তাঁর নাম ও যশ প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়েছিল। তবুও কর্ণগড় যাঁর জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল তিনি হলেন মেদিনীপুরের ‘লক্ষ্মীবাঈ’ রানি শিরোমণি। অজিত সিংহের মৃত্যুর পর (১৭৬০) তাঁর হাতে সিংহাসনের দায়িত্ব আসে আর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। এই দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর রাজ্যশাসন, প্রজাপালন এবং ব্রিটিশদমনে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে কর্ণগড় ছিল বিদ্রোহের পীঠস্থান। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গলমহালের চাষি প্রজারা যে বিদ্রোহ করেন ইংরেজদের ভাষায় তা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’। চুয়াড় শব্দের অর্থ হল গোঁয়ার, অসভ্য ইত্যাদি। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি। বালিজুড়ি, তসরআড়ার জঙ্গলে তির-ধনুকের বিরুদ্ধে সাহেবদের মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের লড়াই চলে প্রায় এক বছর। অবশেষে ১৭৯৯ সালের এপ্রিল মাসে রানির অনুচরদের বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র চুয়াড় বিদ্রোহে ধস নামে। রানি আত্মাহুতি দিয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচান আর চুয়াড়রা টুকরো হয়ে যায় ইংরেজদের গোলাবারুদের সামনে। রাণীর পূজিত মা মহামায়ার মন্দির এখনো এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। পরবর্তী কালে ঝাড়খন্ডের মাতৃসেবক "রঘুবাবা" এই স্থানটির পুনসংস্করণ করেন।প্রাচীরঘেরা চারটি মন্দির সংলগ্ন সুসজ্জিত স্থানটি বেশ মনোরম। মন্দিরগুলির পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বারই ছিল একসময় মুখ্য প্রবেশপথ কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমের তোরণই হল মুখ্য প্রবেশদ্বার। এই তোরণের উচ্চতা প্রায় ৭৫ ফুট। এই তোরণটিকে সাধারণ মানুষজন বলেন হাওয়াখানা বা হাওয়ামহল। তোরণদ্বারটি সুন্দর মন্দিরের আদলে নির্মিত। এর উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা যায়। এই তোরণদ্বারটিকে ‘যোগী খোলা’ বা যোগমণ্ডপ বলা হয়। মহামায়ার মন্দিরে যে সব সাধক শক্তিসাধনার জন্য আসেন তাঁরা প্রথমে এই যোগমণ্ডপের ত্রিতলে বসে যজ্ঞ ও যোগসাধনা করে থাকেন। তোরণদ্বার দিয়ে ঢুকেই সামনে বিশাল চত্বর, চারপাশ ফুলগাছে ছাওয়া। চত্বর পেরিয়েই উৎকল রীতিতে নির্মিত দণ্ডেশ্বর মন্দির। মন্দিরের মধ্যে কোনও শিবলিঙ্গ নেই, রয়েছে এক গভীর গর্ত। এই গর্ত ‘যোনিপীঠ’ নামে খ্যাত। জগমোহনের ভেতরে বাঁ দিকে রয়েছে কালো পাথরের লিঙ্গ মূর্তি। এঁর নাম ‘খড়গেশ্বর মহাদেব’। মন্দিরের দক্ষিণে লাগোয়া মন্দির হল মহামায়া মন্দির। মহামায়া মূর্তিটি অপূর্ব সুন্দর। ইনিই রাজপরিবারের আরাধ্য কুলদেবী। মন্দিরের ভেতর রয়েছে বিখ্যাত এক পঞ্চমুণ্ডি আসন। জনশ্রুতি যে, কর্ণগড়ের বিখ্যাত রাজা যশোবন্ত সিংহ এবং ‘শিবায়ণ’ রচনাকার রামেশ্বর ভট্টাচার্য এই পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। দণ্ডেশ্বর শিব মন্দিরের পিছন দিকে মাকড়া পাথর নির্মিত একটি প্রাচীন বেদির ওপর গত ২৯শে পৌষ ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মেদিনীপুর শাখা কর্তৃক কবি রামেশ্বরের একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে। মহামায়া মন্দিরের পিছনে রয়েছে পবিত্র দুধকুণ্ড। রয়েছে কুয়ো। আশ্চর্যের বিষয় হল, কুয়োর জল সাদা। রয়েছে কল্পতরু বেদি। মন্দির চত্বরে রয়েছে যোগমায়া মন্দির, হনুমান মন্দির, রঘুবাবার মন্দির। এই রঘুবাবা সম্বন্ধে দু-চার কথা না বললে অসংগতি থেকে যায়। ইনি মন্দিরদুটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন বলেই মন্দিরদুটি আজও অক্ষত আছে। মন্দিরগুলির দক্ষিণে রয়েছে পুকুর। মন্দিরগুলি নিয়মিত সংস্কারের ফলে প্রাচীন বলে মনেই হয় না।