জন্ম: ১০ই ডিসেম্বর, ১৮৮৮ সাল
আত্মবলিদান: ২রা মে, ১৯০৮ সাল
সময়টা ১৯০৭ সালের শেষের দিক। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে যে সময়টি চিহ্নিত হয়ে আছে ‘অগ্নিযুগ’ হিসেবে। ‘নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি’ অবিশ্বাস দেখা দেয় তৎকালীন তরুণ সমাজের একটি অংশের মধ্যে। ক্রমশঃ তাঁদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা গড়ে ওঠে যে ‘অস্ত্রশক্তি’ ব্যতীত ‘রাজনৈতিক মুক্তি’ সম্ভব নয়। অর্থাৎ মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের একমাত্র পথ হলো ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’। কিন্তু সুপ্রশিক্ষিত ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো শক্তি ছিল না তাঁদের। তাই তাঁরা বেছে নেন ‘রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা’র পথ। ‘সিক্সবোর রিভলবার’ আর ‘দেশীয় হাতবোমা’ দিয়ে, রাইফেল আর মেশিনগান সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর মোকাবেলা করা অসম্ভব হওয়ায় তাঁরা বেছে নেন ‘গুপ্তহত্যা’র মাধ্যমে ব্রিটিশদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার পদ্ধতি যাতে তাঁরা দ্রুত পালায় ভারত ছেড়ে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য গড়ে ওঠে ‘যুগান্তর’ আর ‘অনুশীলন’ নামের দুটি গুপ্ত সমিতি। ‘সুবোধ মল্লিক’, ‘হেমচন্দ্র’, ‘চারুদত্ত’, ‘বারীন ঘোষ’, ‘ঋষি অরবিন্দ’ এঁরাই ছিলেন নেতৃত্বে। এঁদের নির্দেশেই কাজ করতেন অন্যরা। সে এক উত্তাল সময়। সারা ভারতে শুরু হয় ‘ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ’, ধরপাকড় আর নির্যাতন। বিপ্লবীরা সুযোগ বুঝে গুম করে দেয় ব্রিটিশ শকুনদের। স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা’ রুজু করে তাঁদের উপর চালানো হত শারীরিক নির্যাতন। আর তাঁদেরকে ‘আন্দামান জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ দিয়ে পাঠানো হতো ‘দীপান্তরে’। ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনের’ সময়ে ‘অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে’ একদল কিশোর-তরুণ বিপ্লববাদের মন্ত্র গ্রহণ করেন৷ ‘মজফ্ফরপুরের জেলা ও সেশন জজ’ ‘ডি. এইচ. কিংসফোর্ড’কে হত্যা করার জন্য বাংলার বিপ্লবী সংস্থা ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লকে নিয়োজিত করে৷ কিংসফোর্ডের কলকাতায় অবস্থান কালে (আগস্ট ১৯০৪ থেকে মার্চ ১৯০৮) তাঁর হাতে অনেক বিপ্লবীর বিচার ও শাস্তি হয়৷ ‘যুগান্তর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলির বিরুদ্ধে ‘রাজদ্রোহের অভিযোগের বিচারক’ তিনিই ছিলেন এবং শাস্তি প্রদানও করেছিলেন৷ প্রতিবাদী কিশোর ‘সুশীল সেন’কে প্রকাশ্যে বেত মারার হুকুমও এই বিচারকই দেন৷ ‘হেমচন্দ্র দাস কানুনগো’কে দিয়ে বোমা তৈরি করানো হল৷ জানুয়ারি ১৯০৮ নাগাদ একটি বারোশো পৃষ্ঠার ‘পুস্তক বোমা’ (যা খোলামাত্রই বিস্ফোরণ ঘটাবে) ‘কিংসফোর্ডের গার্ডেনরিচের ঠিকানায়’ পার্সেল করে পাঠানো কিন্তু কিংসফোর্ড বইটি না খুলে আলমারিতে রেখে দেন৷ ফলে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গেলেন৷ বিপ্লবীদের গোপন মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠল এ কাজের দায়িত্ব কাকে দেয়া হবে? ‘বারীন ঘোষ’ ও ‘উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়’ এবার স্থির করলেন ‘কিংসফোর্ড-নিধনের ভার’ দেওয়া হবে প্রফুল্ল চাকীকে৷ আড়াল থেকে মিটিংয়ের কথা শুনে প্রফুল্ল চাকী বললেন, “আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে।” কিন্তু সবাই ভাবলেন এ কাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ‘ক্ষুদিরাম বসু’র নাম ঠিক হলো। ‘ক্ষুদিরামের অভিভাবক সত্যেন বসু’র কাছে চিঠি লিখে পাঠানো হলো। চিঠি অনুযায়ী ১৯০৮ সালের ২৫শে এপ্রিল ‘ক্ষুদিরাম’ কলকাতায় এসে পৌঁছলেন। কলকাতায় ‘গোপীমোহন দত্ত লেনের ১৫ নম্বর বাড়ি’টি ছিল বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই ‘হেমচন্দ্র’ ও ‘উল্লাসকর’ শক্তিশালী ‘book bomb’ তৈরী করেছিলেন। শুরু হলে আবার নতুন প্রস্তুতি।
‘বগুড়া’ থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৯৯ মাইল। জেলার সদর শহর ‘বগুড়া’ ‘করতোয়া নদীর পশ্চিমতটে’ অবস্থিত। ‘বগুড়া’ আধুনিক শহর, ইংরেজদের হাতে ১৮২১ সালে এই শহরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি জেলার সদর শহর। ‘বগুড়া’ জেলার অন্তর্গত ‘ভাসুবিহার গ্রাম’ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকীর জন্মভূমি। প্রফুল্ল চাকীর জন্ম – ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২৭শে অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ১০ই ডিসেম্বর ১৮৮৮ সাল। ইতিহাস বলে, ‘প্রফুল্ল চাকীর জন্মের প্রায় দেড়শো বছর আগে’ সেই ‘বারেন্দ্রভূমে’ আরেক ‘প্রফুল্ল’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম ‘দেবী চৌধুরাণী’ ওরফে ‘প্রফুল্লমুখী’। ‘বিহার’ বা ‘ভাসুবিহার’ প্রফুল্ল চাকীর পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান নয়। ‘প্রফুল্ল চাকীর বৃদ্ধ পিতামহ’ ‘প্রাণকৃষ্ণনারায়ণ চাকী’ ‘পাবনা জেলার অন্তর্গত চাঁচকিয়া গ্রামে’ বাস করতেন। ‘প্রাণকৃষ্ণ চাকী’ উত্তরবঙ্গের এক বিশিষ্ট কায়স্থ বংশের খ্যাতনামা শাক্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। প্রাণকৃষ্ণের একমাত্র পুত্র ‘মহেন্দ্রনারায়ণ’ পিতৃবিয়োগের পরে ‘বগুড়ার অন্তর্গত মাদলা গ্রামে’ এসে বাস শুরু করেন। তাঁর তিন পুত্র ছিল – ‘ইন্দ্রনারায়ণ’, ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ ও ‘চন্দ্রনারায়ণ’। ‘চন্দ্রনারায়ণ’ প্রফুল্ল চাকীর পিতামহ’। পিতৃবিয়োগের পরে ‘চন্দ্রনারায়ণ’ পৈতৃক গ্রাম ‘মাদলা’ পরিত্যাগ করে ‘বিহার’ বা ‘ভাসুবিহার গ্রামে’ এসে বাস শুরু করেছিলেন। ‘চন্দ্রনারায়ণের একমাত্র পুত্র’ ছিলেন ‘রাজনারায়ণ’। ‘রাজনারায়ণের’ দুই বিবাহ – প্রথম স্ত্রী বিবাহের কয়েক বছর পরেই নিঃসন্তান অবস্থায় গত হন, পরে তিনি পুনরায় বিয়ে করেন। ‘রাজনারায়ণের চারপুত্র’ – ‘প্রতাপচন্দ্র’, ‘জগৎনারায়ণ’, ‘চারুচন্দ্র’ ও ‘প্রফুল্লচন্দ্র’; ‘দুই কন্যা’ – ‘কুসুম কামিনী’ ও ‘সৌদামিনী’। প্রফুল্ল চাকী যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়ে চাকী পরিবারের অবস্থা বেশ ভালো। সুতরাং তাঁর ‘জাতকর্মাদি’ বেশ সমারোহের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছিল, আর পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ‘সর্বকনিষ্ঠ’ বলে তিনি পরিবারের আদরের ছিলেন। প্রফুল্ল চাকীর যখন মাত্র তিন বছর বয়স, তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে – ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ‘সন্ন্যাস রোগে’ আক্রান্ত হয়ে তাঁর পিতা ‘রাজনারায়ণ’ প্রয়াত হন। এরপরে সংসারের হাল ধরেন তাঁর বড় ভাই ‘প্রতাপচন্দ্র’। প্রফুল্ল চাকীর হাতে খড়ি হয় পাঁচ বছর বয়সে। বাড়িতে গুরু মশাইয়ের কাছে ‘বর্ণপরিচয়’ শেষ হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ‘প্রতাপচন্দ্র’ তাঁকে ‘নামুজা জ্ঞানদাপ্রসাদ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ ভর্তি করে দিয়েছিলেন। প্রফুল্ল চাকী ক্লাসের ‘ফার্স্ট বয়’ ছিলেন না। দিনরাত বইপড়া তাঁর অভ্যাস ছিল না। স্কুলের পড়া রীতিমতো তৈরি করতেন মাত্র। বাকি সময় খেলাধুলা করতেন ও অন্যান্য ভালো বই পড়তেন। গ্রাম্য বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার পরে তাঁকে ‘রংপুর শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষা লাভের জন্য পাঠানো হয়। তখন তাঁর ১৪ বছর বয়স। এই ‘রংপুরে’ পড়তে গিয়ে তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল।
১লা সেপ্টেম্বর ১৯০৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করে, ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর হবার দিন ঘোষণা হয়েছিল ১৬ই অক্টোবর। ‘বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে’ সারা বঙ্গদেশে ১৬ই অক্টোবর ‘রাখীবন্ধন’ পালিত হয়। ১৭ই অক্টোবর কোন কোন জায়গায় ছাত্ররা ‘উপবাস’ করে ‘খালি পায়ে’ বিদ্যালয়ে আসেন – বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে। ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ ও ‘রংপুর স্কুলের’ ছাত্ররা এই অপরাধে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ওই দিন রংপুর জেলা স্কুলে ‘প্রফুল্ল চাকী’, ‘পরেশ মৌলিক’ প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র এইভাবে প্রতিবাদ করার জন্য শাস্তি পেয়েছিলেন। ‘প্রফুল্ল চাকী’, ‘প্রফুল্ল চক্রবর্তী’, ‘সুরেশ চক্রবর্তী’, ‘নরেন্দ্রনাথ সেন’, ‘কৃষ্ণজীবন সান্যাল’, ‘নরেন বক্সী’, ‘পরেশ মৌলিক’ ছিলেন ‘রংপুর জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র’। ‘বিক্রমপুরের মধ্যপাড়ার’ বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী দেশকর্মী অধ্যাপক ‘নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’ ১৯০৫ সালে এই ‘রংপুর জাতীয় বিদ্যালয়ের’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটাই ছিল ‘বাংলার প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়’। এরপরে ২২শে অক্টোবর ব্রিটিশ সরকার ‘কারলাইল সার্কুলার’ জারি করে, এই ‘সার্কুলার’ অনুসারে ‘ছাত্রদের কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়’। এই সার্কুলারের প্রতিবাদে ছাত্ররা গড়ে তোলে ‘এন্টি সার্কুলার সোসাইটি’। এই সময়ে বিপ্লবী ‘বারীন ঘোষ’ ‘রংপুরে’ আসেন এবং প্রফুল্ল চাকীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে। প্রফুল্ল চাকী ‘রংপুরের কুস্তির আখড়ার পরিচালক’ ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রফুল্ল চাকীর বৈপ্লবিক সাধনার সহযোদ্ধা ‘শ্রীযুক্ত সুরেশ চক্রবর্তী’ লিখেছিলেন, ‘‘রংপুরে আমাদের একটি বৈপ্লবিক দল ছিল। আমরা তিনজনেই (প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকী) অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। এই দলে প্রবেশের অনুষ্ঠান ছিল-বুক কেটে সেই রক্ত দিয়ে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা সম্বলিত একখানি কাগজে স্বাক্ষর করা। এই প্রতিজ্ঞাগুলোর একটি ছিল- প্রয়োজন হলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবো।’’
১৯০৫ সালে বিখ্যাত বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়ে তখনকার ‘পূর্ববঙ্গের প্রথম ছোটলাট’ ‘ব্যামফিল্ড ফুলার’ এক আদেশ জারি করেন যে, কেউ বরিশালের সদর রাস্তায় ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিতে পারবে না। লোকমুখে আরেকটা প্রচার হয়েছিল – কেউ ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিলে তাঁকে গুলি করে মানা হবে। ‘বরিশাল শহরে’ গোর্খা সৈন্য ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই অন্যায় আদেশের প্রথম প্রতিবাদ করেন ‘মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা’র আঠারো বছর বয়সের পুত্র ‘চিত্তরঞ্জন’। ‘চিত্তরঞ্জন ঠাকুরতা’ ‘এন্টি সার্কুলার সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথম ‘বরিশাল’ শহরের রাস্তায় ‘প্রকাশ্যে বন্দেমাতরম ধ্বনি’ তোলেন। গোর্খা সৈন্যরা ও পুলিশ তাঁকে গুলি করেনি বটে, কিন্তু লাঠি দিয়ে মেরে ‘মৃতপ্রায়’ করে ফেলা হয়েছিল, তাঁর জ্ঞানহীন দেহটাকে একটা পুকুরের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। পরে জনরোষের কথা চিন্তা করে পুলিশের এক কনস্টেবল তাঁর দেহ পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুকুর পাড়ে রেখে দিয়ে যায়। মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ক্ষোভের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছিল, এই ঘটনায় সেই আগুনে ঘি পড়ে। বিপ্লবীরাও ‘ব্যামফিল্ড ফুলারের’ উপরে পাল্টা প্রতিশোধ নেবার পথ খুঁজছিলেন। ততদিনে ‘বারীন ঘোষের’ হাত ধরে প্রফুল্ল চাকীও নাম লিখিয়েছেন বিপ্লবী দলে। ‘ব্যামফিল্ড ফুলার’কে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘বারীন ঘোষ’ তাঁর এক সহকর্মীকে নিয়ে ‘রংপুরে’ গিয়ে পৌঁছান। সেই সময়ে তাঁদের টাকার প্রয়োজন। ঠিক হয়, ‘রংপুর’ থেকে ১২ মাইল দূরে একটা বাড়িতে স্বদেশী ডাকাতি করা হবে। কিন্তু এটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হতে পারেনি। প্রফুল্ল চাকীও এই ডাকাতির প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। এটাই ছিল ‘তৎকালীন বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম বৈপ্লবিক ডাকাতির প্রচেষ্টা’। অবশ্য ‘ফুলার হত্যার চেষ্টা’ বন্ধ হয়নি। ‘ফুলার’কে বিপ্লবীরা নজরে রেখেছিলেন। ‘ফুলার’ সাহেবের ধুবড়ী থেকে রংপুর আসার কথা ছিল। ‘ধুবড়ী’তে বিপ্লব দলের একজন সহযোদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল এজন্য যে, ‘ছোটলাটের স্পেশ্যাল ট্রেন’ ‘ধুবড়ী’ ছেড়ে ‘রংপুরে’র দিকে রওনা হলে তিনি ‘রংপুরে’ সাথেসাথে ‘টেলিগ্রাম’ করে খবর দেবেন। ওদিকে ঠিক হয়েছিল যে, ‘রংপুর স্টেশন’ থেকে মাইলখানেক দূরে একটা সুবিধামত জায়গায় লাইনের নীচে ব্যাটারী লাগিয়ে বোমা রেখে আসা হবে। সাথে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় পন্থা – কোন কারণে যদি বোমা না ফাটে, তাহলে স্টেশনের বিপরীত দিকে প্রফুল্ল চাকী ও অন্য একজন বিপ্লবী সাথে রিভলভার ও হাতে ‘লাল লণ্ঠন’ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাঁরা লণ্ঠনটা লাইনে রাখবেন, যাতে স্পেশ্যাল ট্রেনের ড্রাইভার বিপদ সঙ্কেত মনে করে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেয়, আর তারপরে তাঁরা লাটের কামরায় ঢুকে তাঁকে গুলি করে খুন করবেন। কিন্তু এই অভিযানও অসমাপ্ত রইল। কারণ, জানা গেল যে, ‘লাটসাহেব’ ‘রংপুরে’ আসবেন না, তিনি স্টিমার করে ‘গোয়ালন্দ’ রওনা হয়ে গেছেন। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে ‘বারীন ঘোষের নির্দেশে’ একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে প্রফুল্ল চাকী ছুটলেন ‘গোয়ালন্দের’ দিকে। সেখানে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন যে ‘লাটসাহেব’ সেখান থেকে স্পেশ্যাল ট্রেনে কলকাতায় রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও ‘লাটসাহেবের’ পিছনে পিছনে চললেন – কিন্তু ‘ফুলার বধ’ আর করা সম্ভব হলনা। যদিও এর কিছুদিনের মধ্যে ‘ফুলার’ সাহেবের পতন ঘটে – তিনি পদত্যাগ করেন। ‘বঙ্গভঙ্গ’ জনিত আন্দোলনের কারণে ‘বন্দেমাতরম পত্রিকা’য় তাঁকে ‘শায়েস্তা খাঁ’র সঙ্গে তুলনা করে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। আর ‘ফুলার’ পদত্যাগ করার পরে ‘ইংলিশম্যান পত্রিকা’ লিখেছিল, ‘‘এটা বধ্যমঞ্চে হত্যার সামিল, আন্দোলনকারীদের ভয় প্রদর্শনের কাছে এটা আত্মসমর্পণ।’’
১৯০৭ সালে প্রফুল্ল চাকী কলকাতায় আসেন এবং ‘মুরারীপুকুরে’ ‘যুগান্তর দলের’ সাথে যুক্ত হন। ১৯০৭ সালের প্রথমদিকে ‘রংপুর গুপ্ত সমিতির উপশাখার প্রতিনিধিরূপে’ প্রফুল্লচন্দ্র ‘কলকাতা মূলকেন্দ্রের সভ্য’ নির্বাচিত হন। এই সময়েই ‘উল্লাসকর দত্ত’, ‘উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়’ প্রমুখ বিপ্লবীদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। ১৯০৭ সালে দুর্গাপূজার ঠিক আগে, বিপ্লবী ‘চারু দত্ত’ যখন ‘দার্জিলিংয়ে’ রয়েছেন, তখন সেখানে ছুটি কাটাতে এলেন ‘বাংলার তৎকালীন ছোটলাট’ ‘স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার’। সেখানে তাঁর বেশ কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দেবার কথা ছিল। ‘চারু দত্ত’ আগে থেকে খোঁজ নিয়ে রেখেছিলেন যে ‘ফ্রেজার’ স্টেশনের কাছের গির্জায় প্রতি রবিবার সকালে প্রার্থণায় যোগ দিতে আসেন, তাঁর সঙ্গে মাত্র একজন দেহরক্ষী থাকে। ইতিমধ্যে ‘বারীন ঘোষের’ কাছ থেকে ‘ফ্রেজার হত্যার জন্য বোমা’ এসে পৌঁছেছিল আর এক কাজকে রূপ দেবার জন্য প্রফুল্ল চাকীও ‘দার্জিলিংয়ে’ পৌঁছে গিয়েছিলেন। ‘চারু দত্ত’ ও প্রফুল্ল চাকী মিলে স্থির করেন, গির্জায় যাবার পথে ‘ফ্রেজারের গাড়ির উপরে’ বোমা ছোঁড়া হবে। দু’জনের স্থির বিশ্বাস ছিল যে এই অভিযান সফল হবে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের এই অভিযানের আগাম খবর পৌঁছে যায়, এবং ‘ফ্রেজার’ নির্ধারিত রাস্তার পরিবর্তে ‘হিলকার্ট রোড’ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গির্জায় উপস্থিত হন। গির্জাতেও আগাম পুলিশি পাহারার বন্দোবস্ত ছিল। এক ঘন্টা ধরে নির্ধারিত পথের ধারে অপেক্ষা করে শেষে হতাশ হয়ে প্রফুল্ল চাকী ফিরে আসেন। ‘ফ্রেজার হত্যার চেষ্টা’ ব্যর্থ হয়। এরপরে আবার ‘ফ্রেজার হত্যার চেষ্টা’ হয়, দায়িত্বে সেই প্রফুল্ল চাকী, স্থান সেই ‘দার্জিলিং’। ঠিক পরের সপ্তাহে ‘গভর্নর ইলেভেনের’ সঙ্গে ‘কোচবিহার টিমের’ একটা ‘ক্রিকেট ম্যাচ’ ছিল। জানা গিয়েছিল ‘ফ্রেজার’ সেই খেলা দেখতে আসবেন। ঠিক হয়েছিল, ‘ছোটলাটের’ ঠিক পিছনে যেখানে দর্শকদের ভিড় থাকবে সেখানে চারু দত্ত ও প্রফুল্ল চাকী থাকবেন, ‘চারু দত্ত’ ইঙ্গিত করলে প্রফুল্ল বোমা ছুঁড়বেন। কিন্তু ‘ফ্রেজার’ এবারেও এলেন না। হতাশ প্রফুল্ল পরের দিন কলকাতায় ফিরে চলে এলেন।
এরপরে প্রফুল্ল চাকীকে অন্য কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে ‘বাঁকুড়া’য় একটা ডাকাতি করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সেটাও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে আবার ‘ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজারের ট্রেন’ ধ্বংস করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ‘বারীন্দ্র ঘোষ’, ‘উল্লাসকর দত্ত’, ‘প্রফুল্ল চাকী’ ও ‘বিভূতি সরকার’ এরজন্য ‘চন্দননগরে’ গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এরপরে ‘নারায়ণগড়ে’ ‘ছোটলাটের ট্রেন’ ধ্বংস করার দ্বিতীয় চেষ্টা হয় ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। স্থান নির্বাচনের জন্য প্রথমে পাঠানো হয়েছিল ‘হরিশ ঘোষ’ ও ‘শান্তি ঘোষ’কে, কিন্তু তাঁরা স্থান নির্বাচন ভালোভাবে করতে পারেননি বলে প্রফুল্ল চাকী ও ‘বিভূতি সরকার’কে পাঠানো হয়। ‘নারায়ণগড়’ ও ‘বেনাপুর’ স্টেশনের মাঝে একটা জায়গা তাঁরা ‘মাইন’ বসানোর জন্য ঠিক করেন। ৬ই ডিসেম্বর রাত্রে তাঁদের পূর্ব-নির্বাচিত জায়গায় ‘ছোটলাটের ট্রেন’ ধ্বংস করার জন্য প্রায় একফুট গর্ত করে ‘বারীন ঘোষ’, প্রফুল্ল চাকী ও ‘বিভূতি সরকার’ ‘মাইন’ পুঁতে রাখেন। মাইনটা ‘ছয় পাউন্ড ডিনামাইট’ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, ‘ফিউজ’ রেললাইনের উপরে রেখে একটা সুতোর সঙ্গে পাথরের ঢিল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যেন সেটা হওয়ায় উড়ে না যায়। কিন্তু প্রফুল্ল চাকীর এই অভিযানও সম্পূর্ণ সফল হলনা। বোমা ফাটল, রেললাইন বেঁকে ভেঙে গেল, কিন্তু গাড়ি উড়ল না। তবে ইঞ্জিনখানা জখম হল, ‘খড়গপুর স্টেশন’ থেকে আরেকটা ইঞ্জিন এনে রেললাইন ঠিক করে ‘লাটসাহেবের ট্রেন’ নিয়ে যাওয়া হল।
ব্যার্থতার পরে ব্যর্থতা। কিন্তু পরপর এতগুলো ব্যর্থতা সত্বেও কিন্তু বিপ্লবী নেতৃত্ব প্রফুল্ল চাকীর উপরে বিশ্বাস হারাননি। তাঁর মূল কারণ এতগুলো ব্যর্থতা সত্বেও প্রফুল্ল চাকীর ‘ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা’, সাথে অবশ্যই তাঁর ‘অভিজ্ঞতা’। এরপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অত্যাচারী ‘ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড’কে হত্যার। দায়িত্ব দেওয়া হয়, প্রফুল্ল চাকী ও একজন যুবককে যিনি মাত্র বারো বছর বয়স থেকে ‘সাহেব মারতে’ ব্যগ্র ছিলেন – তাঁর নাম ‘ক্ষুদিরাম বসু’। ‘কিংসফোর্ড হত্যার আদেশ’ পালন করার জন্য কলকাতার ‘১৫নং গোপীমোহন দত্ত লেনের বাড়ি’ থেকে বোমা ও পিস্তল সমেত ‘মজঃফরপুরের উদ্দেশ্যে’ রওয়ানা দেন প্রফুল্ল চাকী। বোমা বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘হেমচন্দ্র দাস’ ও ‘উল্লাসকর দত্ত’। ‘হাওড়া স্টেশনে’ মিলিত হন এমন দু’জন তরুণ, যাঁরা একে অপরকে চিনতেন না, এমনকি নামও জানতেন না। ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও প্রফুল্ল চাকী যে একজন অপরজনকে চিনতেন না, তাঁর উদাহরণ স্বরূপ ‘ক্ষুদিরাম বসুর দেওয়া স্বীকারোক্তি’র দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। ১লা মে ১৯০৮ সালে, ‘মজফ্ফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. সি উডম্যানের কাছে’ ‘ক্ষুদিরাম’ স্বেচ্ছায় বাংলা ভাষায় তাঁর ‘স্বীকারোক্তি’ দেন। পরের দিন সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ‘এন. সি. চৌধুরী’। তাঁর দেওয়া ‘স্বীকারোক্তি’টি নিম্নরূপ –
‘‘আমার নাম ক্ষুদিরাম বসু। আমার পরলোকগত বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু। জাতিতে আমি কায়স্থ এবং পেশায় একজন ছাত্র। মেদিনীপুরে আমার বাড়ি। মৌজা মেদিনীপুর, জেলা মেদিনীপুর। আমি মেদিনীপুরে বসবাস করি।
কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্যে আমি কলকাতা থেকে ৫/৬ দিন আগে মজফ্ফরপুরে এসে উপস্থিত হই। স্টেশনের কাছে ধর্মশালাতে আমি উঠেছিলাম। আমার সঙ্গে দীনেশচন্দ্র রায় নামে আরও একজন লোক এসেছিল। সে বলেছিল যে, সে বাঁকিপুরের লোক। আমি তাঁকে হাওড়া স্টেশনেই দেখেছিলাম, তার আগে কখনও দেখিনি। আমাদের দুজনের একরকম উদ্দেশ্য ছিল। আমরা উভয়েই একসঙ্গে যাত্রা করেছিলাম। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে পথে নেমেছিলাম, নানা ধরনের কাগজের সংবাদ পাঠ করে আমি উত্তেজনাবশত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই কাগজগুলি হল ‘সন্ধ্যা’, ‘হিতবাদী’, ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি। কাগজগুলিতে ভারতের ওপর ইংরেজ সরকারের জুলুমের কথা লেখা হত। অবশ্য কিংসফোর্ডের নাম কোথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু যেহেতু তিনি বহু লোককে জেলে পুরেছিলেন, সেহেতু আমি তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিই। আলোচনা করতে করতে তাঁদের কথাও উঠে আসে। অন্য কেউ তাঁকে এই কাজ করতে উসকানি দিয়েছিল কিনা, সে কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি। আমাদের ট্রেনেই হঠাৎ দেখা গিয়েছিল কিনা সে কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি। আমাদের ট্রেনেই হঠাৎ দেখা হয়েছিল এবং সেই সুবাদেই তাঁর সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত। কথায় কথায় সে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে জানায়। আমিও আমার উদ্দেশ্যটা তাঁকে জানাই। গাড়িতে আরও অনেক সহযাত্রী ছিল। কিন্তু আমি তাঁদের কারওর সঙ্গে কথা বলিনি।
আমরা মজফ্ফরপুরের ধর্মশালায় পৌঁছে সেখানে ৪/৫ দিন থাকি এবং তাঁকে (কিংসফোর্ডকে) মারার সুযোগের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলি। দু–একদিন বাইরে থেকে তাঁর বাড়িটিও দেখে আসি। আমরা রোজ সকালবেলা তাঁকে দেখতে পেতাম। আমি একদিন কোর্টে গিয়েও তাঁকে দেখে আসি।
আমার কাছে দুটো রিভলভার ছিল এবং আমার ইচ্ছে ছিল তার একটা দিয়ে তাঁকে গুলি করে মারি। এইগুলো হল সেই রিভলভার (প্রদর্শ নং ১ ও ২)। দীনেশের কাছে ছিল একটা রিভলভার ও একটা বোমা। সে এটা (বোমা) কলকাতা থেকেই তৈরি অবস্থায় নিয়ে এসেছিল। ধর্মশালায় বসে ওটা বানায়নি। তবে ধর্মশালায় বসে সে কী যেন করত। আমি বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এসে দেখতাম যে সে বোমাটা বার করে দেখে আবার আগের জায়গায় রেখে দিত। দীনেশ আমাকে বলেছিল যে এই বোমাগুলো কেমন করে বানাতে হয় সে তা জানে। কিন্তু বোমাটা সে কোথা থেকে জোগাড় করেছিল, সে কথা আমাকে বলেনি। বোমাটা টিন দিয়ে মোড়া ছিল এবং তার আকার ছিল প্রায় এতখানি (হাত দিয়ে প্রায় তিন–চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি আয়তন প্রদর্শন)।
আমার পৌঁছবার দু’দিন পরে বোমাটা কাজের উপযোগী হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মশালায় একটা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগের ভিতরে কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে আমরা সেটাকে ঢেকে রেখেছিলাম। দিন দুই–তিন আমি বোমাটাকে একটা টিনের মধ্যে পুরে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলাম। দীনেশ ও আমি দু–তিনদিন সন্ধেয় বেরিয়ে জজ সাহেবের বাড়ির সামনের ময়দান দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম। আমার তাঁকে (কিংসফোর্ডকে) দু–তিনবার দেখেও ছিলাম। কিন্তু কোনও সুযোগ পাইনি। আমরা তাঁকে (ঘোড়ার) গাড়ির ভেতরেও বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু সব কিছু পরিষ্কারভাবে চিনতে পারিনি।
গতকাল রাতে আমি একটা সুযোগ পেয়েই বোমাটা ছুঁড়ে মারলাম। দীনেশ ও আমি ময়দানে একটা গাছের তলায় একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি দেখলাম (কিংসফোর্ডের) গাড়িটি ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি মনে করেছিলাম যে কিংসফোর্ডের গাড়িটা আমি সঠিকভাবে চিনতে পেরেছি। আর তাই বোমাটাও ছুঁড়ে মারলাম। (অবশ্য) এখন জানতে পারলাম যে আমার ভুল হয়েছে। কনস্টেবলরা আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি কিন্তু একটা বোমাই ছুঁড়েছিলাম। আমি রাস্তায় নেমে গাড়িটির কাছে ছুটে গিয়ে তার ভেতরেই এটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম যে জজ সাহেব বুঝি গাড়ির ভেতরেই রয়েছেন। কিন্তু আসলে সেখানে ক’জন ছিল তা আমি ভাল মতো বুঝতে পারিনি। সময়টা ছিল মোটামুটি আঁধারে ভরা। তখন আমার গায়ে ছিল এই ডোরাকাটা কোট (প্রদর্শ নং ৩)। দীনেশের গায়ে ছিল একটা সাদা রঙের সিল্কের কুর্তা (প্রদর্শ নং ৪)। কিন্তু এটা পরে থাকতে অসুবিধে হওয়ায় সে এটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় গা থেকে খুলে আমায় দিয়েছিল। সে তখন একটা জামা আর চাদর গায়ে দিয়ে নেয়। আমাদের (দুজনের) পায়েই জুতো ছিল। কিন্তু বোমা ফেলার আগে আমরা গাছতলায় ওগুলো ছেড়ে রেখেছিলাম। আমি বোমা ছোঁড়ার জন্যে সবার আগে দৌড়ে গিয়েছিলাম। আর তাই দীনেশ কেমনভাবে আমার পিছু নিয়েছিল, তা খেয়াল করতে পারিনি। দীনেশের কাছেও একটা রিভলভার ছিল, তবে সেটা (তখন) তাঁর হাতে ছিল কিনা তা লক্ষ্য করে দেখিনি। সে গুলি ছুঁড়েছিল কিনা, তাও বলতে পারব না। বোমা ছোঁড়ার ফলে আমি কোনও আঘাত পাইনি। কিন্তু দীনেশ আঘাত পেয়েছিল কিনা, তা জানি না। আমরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে ধর্মশালার দিকে ছুটে গিয়েছিলাম এবং তারপরেই আলাদা হয়ে যাই। আমি (রেল) লাইন ধরে এগোনোর পর সমস্তিপুরের রাস্তায় এসে উঠেছিলাম। (আর) ধর্মশালা থেকে আলাদা হয়ে পড়ার সময় দীনেশ সিধে পথে ছুট দেয়।
ধর্মশালার কাছে ছুটে আসার সময় একজন কনস্টেবল আমাদের ডেকেছিল, কিন্তু আমরা তা কানে না তুলে চুপিসারে ছুট মেরেছিলাম। ওইদিন রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা যখন জজ সাহেবের বাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিলাম, তখন দুজন লোক আমরা কোথায় থাকি সে কথা জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাঁর (কখনও) সাক্ষাৎ হয়নি। ওই লোকটি আমাদের ওখান থেকে চলে যেতে বলে, কেন না সে পথ দিয়ে নাকি সাহেবরা যাতায়াত করে। আমি বলেছিলাম যে, আমি একজন ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছি। সে এলেই চলে যাব। তারপর আমরা পুবদিক ধরে চলে যাই। আমরা খানিকটা পথ গিয়ে আবার ফিরে আসি সেই জজ সাহেবের কোর্ট আর পুকুরের লাগোয়া গাছতলায় যেখানে আমরা (জজ সাহেবের ঘোড়ার) গাড়িটি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম। লোক দুটোর সঙ্গে আমার যখন কথা হচ্ছিল, তখন বোমাটা আমার বাঁহাতেই ধরা ছিল, হাতটা ঝুলছিল। বোমাটা একটা টিনের বাক্সে রাখা ছিল, গাছতলায় পৌঁছনোর আগেই আমরা এই টিনের বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। কেন না এই কাজে আমারই বেশি ইচ্ছে ছিল। ধর্মশালা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি সেখানে একটা ধুতি ফেলে এসেছিলাম। দীনেশ কিছু ফেলে গিয়েছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। দীনেশের বয়েস প্রায় আমারই মতো, তাঁর গোলপানা মুখ আর শরীরের গঠন আমার থেকে কিছুটা ভাল। লম্বায় সে আমারই মতো, ভ্রু জোড়া আলাদা আর আমার মতোই তারও চুল কালো ও কোঁকড়া। সে বলেছিল, তাঁর একজন ভাই বাঁকিপুরে রেলে চাকরি করে।
খবরের কাগজ পড়া ছাড়াও আমি বিপিন পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এদের মতো লোকেদের বক্তৃতা শুনতাম এবং সেগুলো শুনে আমি এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিডন স্কোয়্যারে একজন শক্তসমর্থ সন্ন্যাসীও একবার বক্তৃতা করেছিল। কলকাতায় আমি আমার মামা সতীশচন্দ্র দত্তের সঙ্গে থাকতাম। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক আর কর্পোরেশন স্ট্রিটের ৪ নং কী ৫ নং বাড়িতে থাকতেন। তাঁর স্কুলটাও ছিল ওই কর্পোরেশন স্ট্রিটেই।
এই কার্তুজগুলো (২৩টা ছোট ও ১৪টা বড়) আমারই (প্রদর্শ নং ৫) এবং এগুলি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের একটা বাজার থেকে আমি কিনেছিলাম। আমার কোনও লাইসেন্স ছিল না। অমূল্যরতন দাস নামে একটা ছেলে দুটো রিভলভার এনে দিয়েছিল। আমি তাঁকে এর একটার জন্যে ২৫ টাকা আর অন্যটার জন্যে ১৫ টাকা দিয়েছিলাম। এটা প্রায় দুমাস আগেকার কথা। এই ঘড়িটা (প্রদর্শ নং ৬) আমার আর এই রেলওয়ে টাইমটেবল (প্রদর্শ নং ৭) ও এই মোমবাতি আর দেশলাইটাও (প্রদর্শ নং ৮) আমার। এই টাকা রাখার ব্যাগটাও (প্রদর্শ নং ৯) আমার, এটাতে তিনটে ১০ টাকার নোট, একটা (কাঁচা) টাকা, একটা দু আনি আর কিছু খুচরো পয়সা (মোট ৩১ টাকা ৭ আনা ৩ পাই) আছে। এই টিনের কৌটোটাও (প্রদর্শ নং ১০) আমার। এর ভেতরেই বোমাটা একটা কাপড়ে মুড়ে রাখা ছিল। এই জুতো জোড়াটা (প্রদর্শ নং ১১) আমার আর ওই জোড়াটা (প্রদর্শ নং ১২) দীনেশের। ওই চাদরটা (প্রদর্শ নং ১৩) দীনেশের। সে ওটা মাথায় জড়িয়ে রাখত। চাদরের একটা টুকরো দিয়ে বোমাটা মুড়ে টিনের কৌটৌয় পুরে রাখা হয়েছিল। চাদরটা অন্তত দু–তিনবার ছেঁড়া হয়েছিল। আমি প্রায় এক বছর আগে মেদিনীপুর কলেজ ছেড়েছি।
প্রশ্ন: এই বিবৃতির সবটুকুই কি তোমার?
উত্তর: আমি যা বলেছি, সব সত্যি আর আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় এই বিবৃতি দিয়েছি।’’
নিজের দেওয়া ‘স্বীকারোক্তি’তে ‘শ্রী ক্ষুদিরাম বসু’ অপর একজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছিলেন – ‘দীনেশচন্দ্র রায়’। নিজের বক্তব্যে ‘ক্ষুদিরাম’ জানিয়েছিলেন যে উক্ত ব্যক্তিকে তিনি চিনতেন না, তাঁর সঙ্গে ‘ক্ষুদিরাম’ আগে পরিচিত ছিলেন না। নামের থেকেও পরিষ্কার যে ‘ক্ষুদিরাম’ সত্যিই অপর ব্যক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন না। ‘ক্ষুদিরাম উল্লেখিত’ এই ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছিল একটি ‘ছদ্মনাম’, আসল নাম – ‘শ্রী প্রফুল্ল চাকী’, সরকারিভাবে যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘আত্মহুতি’ বা ‘আত্মবলিদান’ বা ‘আত্মহত্যা’ করা ‘প্রথম শহীদ’। ‘শ্রী ক্ষুদিরাম বসু’ তাঁর ফাঁসির পরে ‘নাম ও খ্যাতি’ পেয়েছেন তার সিকিভাগও পান নি শ্রী প্রফুল্ল চাকী। অথচ তাঁর মৃত্যু, ‘আত্মহত্যা’ নাকি ‘ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ কর্তৃক পরিকল্পিত ভাবে হত্যা’, তা নিয়ে বিতর্ক আজও বর্তমান। আর প্রফুল্ল চাকীর ‘বৈপ্লবিক জীবন’ কম ‘রোমহর্ষক’ নয়। কেবলমাত্র ‘কিংসফোর্ড হত্যা ষড়যন্ত্র ও প্রচেষ্টা’র সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না, তাঁকে তার আগে আরও একাধিকবার ‘বিভিন্ন অপারেশনের দায়িত্ব’ দেওয়া হয়েছিল, যেগুলো উপরে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেগুলো সম্পন্ন করার জন্য তিনি ‘নির্ভীক চিত্তে’ অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, কেউই বিশেষভাবে তাঁর ‘বৈপ্লবিক জীবন ও কর্মকাণ্ড’কে নিয়ে আগ্রহী হন নি ও ‘আলোকপাত’ করেন নি।
‘কিংসফোর্ড’কে হত্যার জন্য প্রফুল্ল চাকী ও ‘ক্ষুদিরাম’ ‘কলকাতা রেলস্টেশনে’ পৌঁছানোর পর ‘বারীণ ঘোষ’ তাঁদের কাছে ‘কিংসফোর্ড’কে মারার জন্য ‘বোমা’ পৌঁছে দিলেন। বোমার সঙ্গে ‘রিভলবার’ কেনার জন্য কিছু টাকা ও ‘মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র’ দেওয়া হল তাঁদেরকে। প্রফুল্ল চাকী ও ‘ক্ষুদিরাম’ প্রথমবারের মতো একত্রিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। দু’জনের মধ্যে কথা হল। ‘কিংসফোর্ড’কে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁরা। এরপর তাঁরা সতর্কতার সাথে চলে যান ‘মজঃফরপুরে’। কারণ সেখানেই বাস করতেন ‘কিংসফোর্ড’। প্রতিদিন ‘ক্লাব হাউজ’ থেকে সন্ধ্যার পর ‘সাদা ফিটন’ গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসতেন ‘কিংসফোর্ড’। পাঁচ দিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না তাঁরা। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল, ষষ্ঠ দিন এলো সেই সুযোগ।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার৷ অমাবস্যা৷ বিপ্লবীদের কাছে খবর ছিল, ‘ইউরোপিয়ান ক্লাবে’ রোজই সন্ধ্যের পর ‘ফিটন গাড়িতে চেপে’ তাস খেলতে যেতেন ‘কিংসফোর্ড’, ফিরতেন সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ৷ জজ সাহেবের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল বোমা-পিস্তল নিয়ে৷ ‘ফিটন গাড়িটি’কে ক্লাবের দিক থেকে আসতে দেখে তাঁরা বোমা ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হলেন, কেননা তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন এই গাড়িটিই ‘কিংসফোর্ডের’ এবং সেখানে তিনিই রয়েছেন৷ গাড়িটি কাছাকাছি আসতেই বোমা ছোড়া হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তা গাড়িটিকে চুরমার করে দেয়৷ ‘কোচম্যান’ ও ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ‘সহিস’ আহত হল এবং ‘ভিতরে বসে থাকা দুই মহিলা’ মারাত্মকভাবে জখম হলেন৷ এই মহিলা দু’জন ছিলেন ‘স্থানীয় উকিল প্রিঙ্গল কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা’৷ তাঁরা ক্লাব থেকে ফিরছিলেন, তাঁদের গাড়িটি ছিল ‘কিংসফোর্ডের গাড়িটির মতোই দেখতে’৷ ‘মিস কেনেডি’ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মারা যান এবং ‘মিসেস কেনেডির’ মৃত্যু হয় ২রা মে সকালে৷ ‘কিংসফোর্ড’ সেদিন একটু পরে ক্লাব থেকে বেরিয়েছিলেন৷
এই ঘটনার ১ ঘন্টা পর ‘পুলিশ সুপার’ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সকল ‘রেল ষ্টেশনে’ খবর পৌঁছে দেওয়া হয়। ‘আততায়ী’কে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ‘৫ হাজার টাকা পুরস্কার’ ঘোষণা করা হয়।
‘ক্ষুদিরাম’ অনেক সতর্কতার সাথে ‘মজঃফরপুর’ থেকে ২৪ মাইল পথ পায়ে হেঁটে ‘ওয়ালি’ ষ্টেশনে পৌঁছান। প্রচন্ড জলের তৃষ্ণা মিটাতে একটি দোকানে যান তিনি। আততায়ীকে ধরার জন্য পুলিশ সমস্ত শহরে ওঁত পেতে ছিল। ‘সাদা পোশাকের পুলিশ’ ওই ‘ওয়ালি ষ্টেশনে’ও ছিল। তাঁরা ‘ক্ষুদিরাম’কে সন্দেহ করে এবং ঠিক জল খাওয়ার সময়ই ‘২ জন পুলিশ’ ‘ক্ষুদিরামের’ দুই হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। সাথে সাথে আরো ‘৫/৬ জন পুলিশ’ ‘ক্ষুদিরাম’কে ঘিরে ফেলে। ‘ক্ষুদিরাম’ও দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘আত্মাহুতি’ দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ‘অস্ত্র মুক্ত’ করে নেওয়ায় তিনি ‘আত্মাহুতি’ দিতে পারেননি। পরে ‘নিজের দেওয়া স্বীকারোক্তি’তে ‘ক্ষুদিরাম’ ‘বোমা হামলার সব দায়’ নিজের কাঁধে নেন। ‘সহযোগীদের’ কথা বলেন না। ফলে ‘বোমা হামলা ও দু’জনকে হত্যার অপরাধে’ ‘ক্ষুদিরামের’ ‘ফাঁসির আদেশ’ হয়।
অন্যদিকে প্রফুল্ল চাকী অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ‘ছদ্মবেশে’ ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ট্রেনে ‘নন্দলাল ব্যানার্জী’ নামে পুলিশের এক ‘দারোগা’ ‘সমস্তিপুর’ (‘মোকামঘাট রেলস্টেশন’) রেল স্টেশনের কাছে প্রফুল্ল চাকীকে দেখে সন্দেহ করেন। প্রফুল্ল আগেই বুঝে গিয়েছিলেন ‘নন্দলাল’ তাঁকে অনুসরণ করছেন তাই তিনিও চেষ্টা করতে থাকেন নিজেকে আড়ালে রাখার৷ ‘মোকামাঘাট’ স্টেশনে এসে প্রফুল্ল কলকাতায় আসার টিকিট কিনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন৷ সেই সময়ে ‘নন্দলাল’, ‘রামাধার শর্মা’, ‘শিবশঙ্কর’, ‘জামির আমেদ’ ও আরও কয়েকজন ‘কনস্টেবল’ মিলে প্রফুল্লকে ধরার চেষ্টা করেন৷ ধরা পড়ে গিয়েছেন বুঝতে পেরে প্রফুল্ল দৌঁড়াতে শুরু করেন৷ কিন্তু সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এঁটে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ প্রফুল্ল স্টেশন থেকে নেমে দৌঁড়ে অনেক দূরে চলে যান। কিন্তু ‘নন্দলাল দারোগা’ তাঁর পিছু ছাড়েননি, বরং ‘‘ডাকাত ডাকাত’’ বলে চিৎকার শুরু করেন। তখন স্টেশনে পাহারারত পুলিশ ও জনতা প্রফুল্ল চাকীকে ধরার জন্য তাঁর পিছু ছুটতে শুরু করে।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই প্রফুল্ল চাকী ‘দারোগা’কে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছোঁড়েন। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এরপর তিনি আর গুলি চালান নি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যদি পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন তাহলে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকী গুলি দিয়ে নিজেকে হত্যা করবেন। যার নাম ‘আত্মহত্যা’। কারণ ধরা পড়ার পর পুলিশের মারের মুখে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। দৌড়ানোর এক পর্যায়ে প্রফুল্ল চাকী কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ‘নন্দলাল দারোগা’ দৌঁড়ে প্রায় তাঁর কাছাকাছি চলে আসেন, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলতেন তাঁকে। এরপরে ‘পুলিশের রিপোর্ট ও বয়ান অনুসারে’, এমন সময় পকেটে রাখা ‘রিভলবার’ বের করে ‘চিবুকের নীচে’ ধরে ‘পর পর ২টি গুলি’ নিজ দেহে বর্ষণ করে ‘আত্মাহুতি’ দেন প্রফুল্ল চাকী। এই ঘটনার পর থেকে মূলতঃ ভারতবাসী জাগতে শুরু করে। আর তখন থেকেই ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম’ আরো ‘জঙ্গি রূপ’ ধারণ করে।
‘জীবনের একেবারে শেষ পর্বে’ গুলিতে প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু হয়৷ এখন প্রশ্ন হল, গুলি কে করেছিল? ব্রিটিশ পুলিশের বয়ানে লেখা হয়েছিল, প্রফুল্ল নিজের দিকে বন্দুক তাক করে ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন৷ কিন্তু ‘পুলিশ রেকর্ডে রাখা তাঁর মৃতদেহের ছবি’ অন্য কথা বলে৷
‘প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু’, ‘হত্যা’ নাকি ‘আত্মহত্যা’, অতীতে ও সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। ‘পশ্চিমবঙ্গের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ’ ‘শ্রী নির্মল নাগ’ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক অতীতে ‘এই সময়’ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন –
“প্রফুল্লর শরীরে যে-দু’টি গুলির ক্ষতস্থান দেখা যাচ্ছে, ফরেনসিক ও বিভিন্ন সমীক্ষার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে৷ কেননা, তিনি ডান-হাতি ছিলেন এবং ওই দু’টি স্থানে অর্থাৎ শরীরের বাঁ দিকে পিস্তলে নল ঘুরিয়ে নিজে-নিজে একটি নয় দু’টি গুলি করা রীতিমতো অসুবিধাজনক শুধু নয়, তা প্রায় অসম্ভবই (not within easy access)৷ এ ছাড়া গুলির ক্ষতের আকৃতি এবং ব্যাস দেখে মনে হয় না এগুলি near contact অথবা contact shot-এর কারণে ঘটেছে, যা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সব সময় হয়ে থাকে৷ কালো রঙের ছাপও সেখানে অনুপস্থিত৷
ব্রিটিশ পুলিশের রেকর্ডের বয়ান অনুযায়ী, প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিলেন এই নিশ্চিত-মত এ যাবত্ সকলেই পোষণ করেছেন৷ অথচ, যে-যে যুক্তিগুলি তাঁর আত্মহত্যার তত্ত্বকে সমর্থন করছে না সেগুলি সংক্ষেপে এইরকম –
১) সুদেহী প্রফুল্লর সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল থাকতে বিনা বাধায় তিনি আত্মসমর্পণ করে স্বহননে প্রবৃত্ত হবেন এমন দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না৷ কেউ কেউ বলেছেন, তিনি পুলিশের উদ্দেশে গুলি ছুড়েছিলেন, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷ অথচ, অন্য তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি পিস্তল ছোড়ায় দক্ষ ছিলেন, গুলি ছোড়ার রীতিমতো অভ্যাস করতেন মুরারিপুকুর-বাগানবাড়িতে৷ তবে বিপদকালে উত্তেজনাবশে তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন, সেটাও হতে পারে!
২) তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল৷ শুধু একটিই? তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী? কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ? এসব অত্যাধিক দৈহিক পীড়নের ফল নয় কী?
৩) দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে দুইবার গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব? প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন৷
৪) vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না৷
৫) কোনও competent authority কেন, কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটও নেই৷
অতএব, প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন প্রচলিত এই ‘অতিসরল’ কথাটি মেনে নিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে৷ বরং হত্যার লক্ষণগুলিই এখানে প্রকট৷ প্রফুল্ল মৃত্যুর ঘটনাটি সম্ভবত এই রকমভাবে ঘটেছিল বলে আমার অনুমান৷
মোকামা স্টেশনে প্রফুল্লকে বাগে পেয়ে কর্তব্যপালনে অবিচল পুলিশেরা সকলে মিলে লাঠি দিয়ে ও যথেচ্ছ দৈহিক পীড়নে তাঁকে কাবু করে এবং অর্ধচৈতন্য বা অচৈতন্য করে ফেলে৷ এর পর তাঁরই পিস্তল দিয়ে একটি ফাঁকা আওয়াজ এবং অবশেষে তাঁর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দু-দু’টি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে৷ যদিও অনেকেই বলেছেন, পুলিশের উদ্দেশে প্রফুল্ল একটি গুলি করেছিলেন এবং তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷ এটা হয়ে থাকলে পুলিশ কোনওভাবে তাঁর হাত থেকে পিস্তলটি ছিনিয়ে নিয়ে সেটি দিয়েই তাঁকে হত্যা করে৷
প্রফুল্লর পিস্তলের ম্যাগাজিনে ৭টি কার্তুজ ভরার ব্যবস্থা ছিল এবং সম্ভবত প্রফুল্ল ৭টি কার্তুজই ভরেছিলেন৷ পিস্তলটি বাজেয়ান্ত করে দেখা যায়, সেখানে ৪টি কার্তুজ রয়েছে, অর্থাত্ ৩টি খরচ হয়েছিল৷ ছবিতে দু’টি গুলির ক্ষত শরীরে দেখা গেছে৷ তা হলে আর একটি গুলির লক্ষ্য জানা যাচ্ছে না, হতে পারে তা পুলিশের উদ্দেশেই, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল, অথবা প্রফুল্লর শরীরের অন্য কোনও অংশে তা আছে, যা ছবিতে দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু ফোটো নেওয়া ছাড়া (দু’টি ছবিরই শুধু সন্ধান মেলে) পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য-কর্তব্যের কোনওটিই পালিত হয়নি৷ এবং তাই আসল সত্য নিয়ে এই এত দিন পরেও ধোঁয়াশা রয়ে যায়৷’’
‘ঘটনার নৃশংসতা’ কিন্তু প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যুর পরেও শেষ হয়নি। প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যুর পরে, ‘তাঁর পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার জন্য’ তাঁর ‘মৃতদেহ’ থেকে ‘মস্তক ছিন্ন’ করে, তারপরে সেই ‘ছিন্ন মস্তক’ ‘এক আধার স্পিরিটে ডুবিয়ে’ পাঠানো হয়েছিল কলকাতায়। ‘দারোগা নন্দলাল ব্যানার্জি’ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিল ‘এক হাজার টাকা পুরষ্কার’ এবং এর ঠিক আট মাস আট দিন পর বিপ্লবীরা ‘নন্দলাল’কে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করেছিল। কথিত আছে যে, ‘কলকাতার গড়ের মাঠেরই কোন এক স্থানে’ ‘প্রফুল্ল চাকীর ছিন্ন মস্তক’ মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল ‘ব্রিটিশ পুলিশ’।