Skip to content

বাংলাদেশে এবার পাকিস্তান নিয়ে বিবাদে ছাত্র উপদেষ্টারা ও জামায়াতে ইসলামি!

ঢাকা, জাকির হোসেন : মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গত ন’মাসে তারা সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক মজবুত করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে। ইউনুস সরকারের সমর্থক দল জামায়াতে ইসলামি, হেফাজতে ইসলাম এবং এনসিপি-র মধ্যেও ‘পাকিস্তান ভজনা’ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর জেরে আচমকা বদল সমীকরণে! সুনির্দিষ্ট হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের একাধিক টেরর-ক্যাম্প গুঁড়িয়ে গোটা বিশ্বকে ভারত একটা কড়া বার্তা দেওয়ার পরেই ইউনুসের অনুগত ছাত্রদের একাংশের সঙ্গে পাকিস্তান-অনুগত জামায়াতে ইসলামির মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে বিবাদ— পাকিস্তানকে এতটা মাথায় তোলা কি ঠিক হচ্ছে? এই নিয়ে ইউনুস মন্ত্রিসভার দুই ছাত্রনেতা মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদের প্রকাশ্য বিবৃতিতে চক্ষুশূল হয়েছে জামায়াত নেতাদের। আবার সরকারে থাকা দুই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নবগঠিত দল এনসিপি-র দক্ষিণবঙ্গের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ এনেছেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে এরা বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করছেন। এই সবের মধ্যেই আবার পুলিশের হাতে বেদম মার খাওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ থামাতে গিয়ে মাথায় বোতলের বাড়ি খেয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ। হ্যাঁ, এই সেই মাহফুজ, যাঁকে হাসিনা-উচ্ছেদ অভিযানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে আমেরিকাতে একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ইউনুস। সঙ্গীদের মাহফুজ বলেছেন, তিনি জামায়াতের সমালোচনা করেছেন বলেই তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবির তাঁকে নিশানা করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে মাহফুজের ফরমান— ‘পরিচিত সব ছাত্র শিবির কর্মীকে যেন বহিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়। আমি এদের শেষ দেখে ছাড়ব!’ রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, ইউনুস সরকারের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামিই কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রদের নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেছে। জামায়াত ও তাদের সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরই জেলাস্তর পর্যন্ত এই দলের কমিটি গড়ে দিয়ে ছাত্র নেতাদের হাতে তা তুলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার উচ্ছেদের পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কট্টর বিরোধিতা করা জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান প্রকাশ্যে এসে স্বাধীনতার পক্ষে নানা কথা বলে জল ঘোলা করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা এতটাই ভয়ানক ও ঘৃণ্য যে, কিছুতেই তারা কাঙ্ক্ষিত গ্রহণযোগ্যতা জোটাতে পারছে না। সেই কারণেই ছাত্রদের সামনে আনার কৌশল নেয় তারা। কারণ একাত্তর নিয়ে এদের অন্তত প্রশ্নের মুখে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এদিকে, পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পাল্টা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সুর চড়াতেই ইসলামাবাদকে পাশে থাকার বার্তা দিতে ভারত-বন্ধু হিসাবে পরিচিত আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউনুস সরকার। কিছুটা আচমকাই হাসনাতের নেতৃত্বে এনসিপি-কে মাঠে নামানো হয়। পাকিস্তানপন্থী সব শক্তিই তাদের পাশে দাঁড়ায়। প্রকাশ্যে আসে জঙ্গি নেতারা। নিষিদ্ধ সংগঠনের জঙ্গিরা আইএস-এর পতাকাও ওড়ায়। সম্প্রতি শাহবাগ মোড়ের এক জমায়েতে ভারত-বিরোধী জিগিরের পাশাপাশি ওঠে কিছু বিতর্কিত স্লোগানও। যেমন— ‘গোলাম আজমের বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের ঠাঁই নাই’, কিংবা ‘মুক্তিযুদ্ধ আসলে ছিল ভারতের গোলামি’। এই ধরনের স্লোগান নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে প্রাক্তন ছাত্রনেতা তথা বর্তমান সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ লেখেন, ‘…দিল্লির গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্তি পেয়েছি পাকিস্তানের দাসত্ব করার জন্য নয়।’ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুকে লেখেন, ‘একাত্তরের প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চলিয়েছে। (পাকিস্তান অফিশিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনও ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে-বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করা বন্ধ করতে হবে।’ মাহফুজ মাদ্রাসা ছাত্র হিসাবে বরাবরই জামায়াতের বিরোধী। সেই কারণেই সম্ভবত তিনি এবং আসিফ মাহমুদ মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে এনসিপি-র নেতৃত্বে আসেননি। কারণ এই দলটি আগাগোড়া তৈরি করে দিয়েছে জামায়াতে ইসলামি। হাসনাতের পাশাপাশি এনসিপি-র অন্য নেতা সারজিস আলম, আব্দুল হান্নান মাসউদরা জামায়াতের সঙ্গে দলের সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। দুই উপদেষ্টা পাকিস্তান ও জামায়াতের সমালোচনায় সরব হওয়ায় হাসনাত অভিযোগ করেছেন, এঁরা আন্দোলনে বিভাজন আনতে চাইছেন। দুই নেতা উপদেষ্টার পদ না-ছাড়ায় তাঁদের উপরে ঈর্ষাজনিত ক্ষোভের বর্ষণও ঘটিয়েছেন হাসনাত। অর্থাৎ পাকিস্তান ও জামায়াতকে নিয়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে গোড়া থেকেই যে ফাটল ছিল, সাম্প্রতিক ঘটনায় তা আরও চওড়া হয়েছে ওপার বাংলায়। এর মধ্যে সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে মাহফুজ লেখেন, ‘গোলাম আজমের বাংলাদেশ— এই স্লোগান দেওয়াটা সম্পূর্ণ ভুল হয়েছে। গোলাম আজম বাংলাদেশ সৃষ্টিরই বিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন দেশদ্রোহী, রাজাকার।’ এর জবাবে জামায়াতের প্রাক্তন আমির তথা প্রয়াত গোলাম আজমের পুত্র (এখন দলের কেন্দ্রীয় নেতা) আব্দুল্লাহিল আমান আজমি লেখেন, ‘গোলাম আজমকে যারা রাজাকার বলে, তারা ভারতের দোসর, দালাল, গোলাম ও পা-চাটা কীট।... বেহায়াদের লজ্জা-শরম নাই। তারা ঘেউ ঘেউ করছেই।’ এই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস এখন মাহফুজের উপদেষ্টা পদ রক্ষা করতে পারেন কি না, তা নিয়েই কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে ‘বদলের বাংলাদেশ’ নতুন করে টালমাটাল। বলা হচ্ছে— এ যেন, ভারতের মিসাইল পড়ল পাকিস্তানে, ফাটল ধরল ইউনুসের সরকারে।

Latest